হৃদয় খান।

মন দিয়ে মন বোঝা যায়, গভীর বিশ্বাস শুধু নীরব প্রাণের কথা টেনে নিয়ে আসে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আমাদের পরিবারে সবার ছোট সদস্য টি হচ্ছি আমি। শৈশব থেকেই পরিবারে সবার কাছ থেকে ছোট হওয়ার কল্যানে আলাদা একটা ভালোবাসা পেয়েছি । কেমন জানি আমার প্রতি পরিবারের সদস্যদের একটা বিশেষ মায়া কাজ করে।
সুুখ-দুঃখে পরিবারের সাথে এভাবেই কেটে যাচ্ছে আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। পরিবারে সদস্যদের ভিড়ে আমার সবচাইতে বেশি কাছের মানুষ হচ্ছেন আমার আম্মা।
অবশ্য বাকিদের প্রতি ও মায়া আছে। কিন্তু আমার আম্মাকে আমার মন খারাপের সময়ে এবং ভালোলাগার প্রতিটি মুহূর্তে পাশে পেয়েছি।
২৫ বছর বয়সে এসে ও শিশুদের মত উনার কাছ থেকে স্নেহ,ভালোবাসা পাচ্ছি। অবশ্য আমি শুনেছি মায়ের কাছে সন্তানের বয়সটা শুধু সংখ্যা মাত্র। মায়ের ভালোবাসার কাছে সন্তানের বয়স তুচ্ছ।
এবার আসি মূল কথায়, ২০১৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভর্তি হই। বাংলাদেশেসহ যখন সারাবিশ্বে করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ে তখন প্রতিটি মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আমি তখন টিউশনি করতাম। অনেক মায়ার ছাত্রছাত্রী তখন তৈরি হয়েছিলো। করোনা মহামারীর এই খারাপ সময়ে তাঁদের এবং পরিবারের সদস্যদের নিয়েই অধিকাংশ সময় কাটতো আমার।
করোনা মহামারীর প্রভাব যখন কিছুটা কমে আসে তখন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। ভাবলাম উচ্চমাধ্যমিক শেষ করলাম এখন ত পরিবারের জন্য কিছু করার চেষ্টা করি। অবশ্য পরিবারের কেউই আমার কাছ থেকে সেটা প্রত্যাশা করেনা। উনাদের উদ্দেশ্য হলো আমি যেনো বাড়িতে থেকেই আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাই।
কিন্তু আমি ত বড় হয়েছি আমার মনকে বুঝাতে পারছিলাম না। কারণ আমার সাথের অনেক বন্ধু-বান্ধব পরিবারকে আর্থিক সাপোর্ট (কেউ প্রবাসে গিয়ে,কারো বিভিন্ন চাকরি হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে) দিয়ে যাচ্ছে।
সিদ্ধান্ত নেই ঢাকা গিয়ে চাকরি করে পরিবারকে আর্থিকভাবে সামান্যটুকু হলেও সাপোর্ট দিব। পরিবারের সবাইকে কোনভাবে রাজি-খুশি করে চলে যাই ঢাকায়।
অবশ্য ছাত্র-ছাত্রীদের জানাই নি। কারণ করোনা মহামারীর এই সময়ে কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ ঘোষণা ছিলো। তাই সুযোগ ছিলো শিক্ষার্থীদের মায়া থেকে ছুটে যাওয়ার।
ঢাকায় যাওয়ার পর সেখানে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে আমার চাকুরী হয়। বেতন ও মোটামুটি ভালোই। পরিবার ছাড়া,নিজের বন্ধুদের ছাড়া এই প্রথমই ছিলো নতুন পরিবেশে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার নতুন অভিজ্ঞতার চ্যালেঞ্জ। নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ আসতে লাগলো আমার জীবনে।
প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে তখন। যে আমি সারাদিনের ভেতর আম্মাকে কয়েকবার জড়িয়ে ধরতাম।
সেই আমি কি না ৬ দিন ধরে কাজের চাপে উনার সঙ্গে কোন যোগাযোগ করতে পারছি না। কাজের চাপ এতটাই ছিলো সন্ধ্যা শেষে অফিসের কাজ শেষ করে রাতে না খেয়েই ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। অথচ বাড়িতে কোনদিন রাতে না খেয়ে ঘুমানোর সুযোগ হয়নি।
আমার মনে আছে ছোটবেলা আমাকে আম্মা ঘুম থেকে উঠিয়ে মুখে তুলিয়ে খাওয়াতেন আমি তখন চোখ মুজে রাখতাম। তবুও না খেয়ে ঘুমাতে পারিনি। ৭দিন পর শুক্রবার ছুটির দিনে বিকালে আম্মাকে ভিডিও ফোন দিলাম। আমি তখন হাসছিলাম আর বলছিলাম আম্মা এখানে সব কিছু ঠিকঠাক আছে, আমি খুব ভালো আছি, কোন চিন্তা কইরো না, আমার খুব ভালো লাগতাছে।
অথচ মায়ের মন মা সন্তানের মুখ দেখলেই সবকিছু আন্দাজ করতে পারেন। এই শহরে নেই কেউ মায়ের মতো চাঁদ। উনি শুধু একটা কথাই বলেছিলেন তরে ছাড়া আমরা কেউ ভালো নাই রে ফুত। বলেই কান্না করে দিছিলেন। আমি তখন হেঁসে বললাম আম্মা তুমি চিন্তা কইরো না গো? আমি খুব তাড়াতাড়ি ছুটি লইয়া আইমু বাড়িত। ফোন রেখে দেওয়ার পর অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। পরেরদিন সকালে এক ছাত্রীর ফোন, অপর পাশ থেকে কান্নার শব্দ আসলো।
সালাম দিয়ে বলতে লাগলো স্যার আপনি আমরারে ছেড়ে কেমনে ঢাকাতে যাইলাইন?আমরার কি হবে? আমরা আপনাকে ছাড়া থাকবো কেমনে? ছাত্রীর প্রশ্নের উত্তরগুলো তখন আমার কাছে ছিলোনা। আমি কোন উত্তর না দিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। পরেরদিন সিদ্ধান্ত নিলাম এই পরিবেশ আমার জন্য উপযুক্ত না।
চলে যাব আমি আমার সেই পুরোনো পরিবেশে মায়ের কোলে। আল্লাহর উপর ভরসা করে চলে আসি বাড়িতে। ভাবলাম আল্লাহ অবশ্যই আমার জন্য ভালোর কিছুই রাখবেন।
বাড়িতে ঐদিন আনন্দ উৎসব শুরু হলো। আশেপাশের প্রতিবেশীরা ও দৌড়ে আসলো আমাকে এক নজর দেখার জন্য। আসলে ঢাকায় না গেলে আমাকে যে মানুষ এতটা ভালোবাসে সেটা জানতে পারতাম না।
ছাত্র-ছাত্রীদের মনে ও তখন মহা আনন্দ ও খুশির আমেজ। সেই আগের মতো শুরু করতে লাগলাম টিউশনি। সম্প্রতি সিলেটের জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর দীপঙ্কর দাশ দ্বীপ সদা হাস্যোজ্জ্বল ছেলেটা কি না মালয়েশিয়ায় পড়াশোনা করতে গিয়ে সেখানে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলো। আসলে মৃত্যু অনিবার্য এতে কারো হাত নেই। দীপঙ্কর দাশ দ্বীপের তাঁর মায়ের প্রতি আলাদা একটা টান ছিলো। আমাদের এই সংক্ষিপ্ত জীবনে কতকিছু পাওয়ার আকাঙ্খা।
কিন্তু আমরা হয়তো এটা ও জানি মৃত্যুর ডাক যখন আসবে তখন আমাদের এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে। তখন এক সেকেন্ড সময় ও আমরা পাবো না।
দ্বীপের পেজে কিছু পোস্ট হতে বুঝা যায় নিজের বেড়ে উঠা পরিবেশের সাথে সেখানকার পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটা তাঁর পক্ষে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিলো।
তাই সে হতাশায় ও ভুগেছিলো।দ্বীপের এই মৃত্যুতে সারা দেশের মানুষ ব্যতিত। ব্যতিত হয়েছি আমিও। আমাদের উচিত যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কয়েকবার ভেবে নেওয়া।
হুটহাট করে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়া। নিজের বর্তমান পরিবেশ ও যেখানে যাবেন সেখানকার পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা নেওয়া। মনের কথা শুনুন। মনকে প্রশ্ন করুন। মন যা বলে তাই করুন।
অকাল মৃত্যুতে ঝড়ে পড়া দ্বীপের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।
লেখক
সিএইচও (কমিউনিটি হাব অর্গানাইজার)
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়, বানিয়াচং, নবিগঞ্জ, হবিগঞ্জ।
মন্তব্য প্রতিবেদন 
















