
আজ ২৮শে জুলাই, কিংবদন্তী বিপ্লবী জননেতা কমরেড মণি সিংহের আজ ১২৫ তম জন্মদিন। এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি আজীবন আপোষহীন এই মহান নেতাকে, যিনি শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ে উৎসর্গ করেছিলেন নিজের জীবন।
প্রারম্ভিক জীবন ও বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ
কমরেড মণি সিংহ ১৯০১ সালের ২৮ জুলাই কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়সেই বাবা কালী কুমার সিংহকে হারানোর পর মা সরলা দেবীর সাথে ময়মনসিংহের (বর্তমান নেত্রকোণা) সুসং দুর্গাপুরে চলে আসেন। এখানেই জমিদার পরিবারের অংশীদারিত্বে তাদের নতুন জীবন শুরু হয়।
স্কুল জীবন থেকেই মণি সিংহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ‘অনুশীলন’ দলে যোগ দিয়ে তিনি দ্রুতই বিপ্লবী কার্যক্রমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯২১ সালের অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের বিশাল গণজাগরণ তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে এবং সন্ত্রাসবাদের কার্যকারিতা নিয়ে তার মনে সংশয় জাগে। এই সময়েই তিনি শ্রমিক আন্দোলন ও কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে মনোনিবেশ করেন। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে, ১৯২৫ সালে প্রখ্যাত বিপ্লবী গোপেন চক্রবর্তীর সাথে আলোচনার পর তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে তার জীবনদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন।
কমিউনিস্ট রাজনীতিতে আত্মনিবেদন ও কৃষক আন্দোলন
১৯২৮ সাল থেকে কমরেড মণি সিংহ কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিজেকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে উৎসর্গ করেন। এই সময়ে তিনি কলকাতার শ্রমিক আন্দোলনে নিবেদিতভাবে কাজ করেন এবং ১৯৩০ সালের ৯ মে গ্রেফতার হন। ১৯৩৫ সালে জেল থেকে মুক্তি পেলেও তাকে নিজ গ্রাম সুসং দুর্গাপুরে অন্তরীণ রাখা হয়। এখানেই কৃষকদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে নিজ মামাদের জমিদার পরিবারের সাথে তার বিরোধ সৃষ্টি হয়। পাটের ন্যায্য মূল্য দাবিতে কৃষকদের পক্ষে ভাষণ দেওয়ায় তার দেড় বছরের কারাদণ্ড হয়।
১৯৩৭ সালে জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর তাকে পার্টির সদস্য হিসেবে জানানো হয়। এরপর তিনি দুর্গাপুরে মায়ের সাথে দেখা করে কলকাতার শ্রমিক আন্দোলনে ফিরে যেতে চাইলেও, এলাকার মুসলমান কৃষক ও গাড়ো হাজং সহ আদিবাসীরা তাকে ‘টংক প্রথার’ বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। মণি সিংহ এরপর সর্বতোভাবে টংক আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন এবং অচিরেই তিনি এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে ১৯৪১ সালে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করে ১৫ দিন আটক রাখা হয়। ছাড়া পেয়ে তিনি পরিস্থিতি বুঝে আত্মগোপনে চলে যান।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পাকিস্তান আমলের ভূমিকা
১৯৪৪ সালে মণি সিংহ সারা বাংলার কৃষাণ সভার প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোণায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কৃষাণ সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি সম্মেলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন। ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি অসংখ্যবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করেছেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ণ গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজের আদর্শকে যারা সামনে নিয়ে এসেছিলেন, মণি সিংহ ছিলেন তাদের অন্যতম। এই কাজ করতে গিয়ে তার ওপর নেমে আসে পাকিস্তান সরকারের দমন-পীড়ন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ২০ বছর তাকে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি ছিল এবং আইয়ুব সরকার তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। ১৯৫১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় সম্মেলনে তিনি আত্মগোপন অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালের তৃতীয় সম্মেলনেও তিনি পুনরায় পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্থ সম্মেলনে (যা পার্টির প্রথম কংগ্রেস হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল) তিনি জেলে থাকাকালীন সময়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশে ভূমিকা
১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের চাপে অন্যান্য রাজবন্দীর সাথে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। কিন্তু একই বছর ২৫ মার্চ সামরিক আইন জারি হলে তিনি জুলাই মাসে আবার গ্রেফতার হন। পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় অনেক নেতাকে মুক্তি দিলেও ইয়াহিয়া সরকার কমরেড মণি সিংহকে মুক্তি দেয়নি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বন্দীরা রাজশাহীর জেল ভেঙে তাকে মুক্ত করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন-সাহায্য-সহযোগিতা আদায়ে কমরেড মণি সিংহের অবদান ছিল অবিসংবাদিত। তিনি ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নির্বাচিত হন।
স্বাধীনতার পর কমরেড মণি সিংহ পূর্ণ গণতান্ত্রিক এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে সোচ্চার হন। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেস এবং ১৯৮০ সালের তৃতীয় কংগ্রেসের মণি সিংহ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কমিউনিস্ট পার্টি আবার বেআইনি ঘোষিত হয়। জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন চলাকালে ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝিতে ৭৭ বছর বয়সী মণি সিংহ আবার গ্রেফতার হন এবং জিয়ার শাসনামলে তাকে ৬ মাস কারাগারে অন্তরীণ থাকতে হয়।
শেষ জীবন ও উত্তরাধিকার
কিংবদন্তী এই বিপ্লবী নেতা ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে পার্টির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন এবং ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার দীর্ঘ বিপ্লবী জীবনের অবসান ঘটে। জাতীয় জীবনে অসাধারণ অবদান ও অনন্য কীর্তির জন্য তিনি ‘স্বাধীনতা পুরস্কারে’ ভূষিত হন।
আজীবন বিপ্লবী, একজন আদর্শবান, ন্যায়নিষ্ঠ, সৎ, সংগ্রামী ও আপোষহীন, সময়ানুবর্তী এবং বিপ্লবী শৃঙ্খলা রক্ষায় অবিচল, মানবতাবাদী ও দেশপ্রেমিক এই মহান নেতার জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও লাল সালাম।
কমরেড মণি সিংহের জীবন ও আদর্শ আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং শোষিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে অনুপ্রাণিত করবে। তার সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, একটি ন্যায়ভিত্তিক ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আজও অমলিন।
তথ্য সূত্র- কমরেড মনি সিং এর বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ থেকে সংগৃহিত।