
পাঞ্জাব কিংসের মালিক প্রীতি জিনতা (বাঁয়ে) ও দলটির অধিনায়ক শ্রেয়াস আইয়ারছবি: এক্স, বিসিসিআই
সালমান খানের সেই টুইট আজ আবার আলোচনায়! কোন টুইট, মনে করতে পারছেন কি?
২০১৪ সালের ২৮ মে আইপিএলে প্রথম কোয়ালিফায়ারে শাহরুখ খানের কলকাতা নাইট রাইডার্সের কাছে হেরে যায় প্রীতি জিনতার পাঞ্জাব কিংস (তখনকার নাম কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব)। সেই রাতেই বলিউডের আরেক ‘খান’ সালমান টুইটারে (বর্তমানে এক্স) লেখেন, ‘জিনতার দল কি জিতেছে?’
নাহ্, সে সময় তো নয়ই, প্রীতি জিনতার দল পাঞ্জাব এখনো আইপিএল জেতেনি। তবে এবারের মৌসুমে পাঞ্জাবের দাপট দেখেই কি না, এক ভক্ত কদিন আগে সালমানের সেই পোস্টে লিখেছেন, ‘সাল্লু ভাই, এই টুইট মুছে ফেলার সময় এসেছে। এই বছর ওরা (আইপিএল) জিতবে।’
পাঞ্জাব কিংস এখন সত্যি সত্যিই আইপিএল জেতার খুব কাছাকাছি। আহমেদাবাদে কাল রাতে দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের দর্প চূর্ণ করে ফাইনালে উঠেছে পাঞ্জাব।
সর্বশেষ ২০১৪ সালেই প্রথম কোয়ালিফায়ার হারের পর দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার জিতে ফাইনালে উঠেছিল প্রীতির দল। সেবার শিরোপা লড়াইয়ে শাহরুখের কলকাতার কাছে হেরেই প্রীতির হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছিল, যা হয়তো গত ১১ বছরেও সারেনি।
কিন্তু সদা হাস্যোজ্জ্বল প্রীতি এবার আরও চওড়া হাসি হাসতে পারেন। তাঁর এত বছরের বিনিয়োগ সার্থক হতে পারে। মিলতে পারে সব হিসাব। তাঁর আক্ষেপ ঘোচাতে পারেন অকুতোভয়, নির্ভীক এক অধিনায়ক—শ্রেয়াস আইয়ার।
শ্রেয়াস আইয়ারের নেতৃত্বগুণ
শ্রেয়াস আইয়ারের নেতৃত্ব সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছেছবি: বিসিসিআই
যুবরাজ সিং থেকে কুমার সাঙ্গাকারা, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট থেকে জর্জ বেইলি, রবিচন্দ্রন অশ্বিন থেকে শিখর ধাওয়ান—বড় মাপের তারকারা পাঞ্জাবকে নেতৃত্ব দিয়ে যা পারেননি, আগামীকালের ফাইনালে আইয়ার সেটাই করে দেখাতে পারেন।
৩০ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব তো দিয়েছেনই, যশপ্রীত বুমরা–ট্রেন্ট বোল্টদের বিপক্ষে ৫ চার ও ৮ ছক্কায় ৪১ বলে উপহার দিয়েছেন ৮৭ রানের মনোমুগ্ধকর ম্যাচ জেতানো ইনিংস। ইনিংসটি খেলার পথে আইপিএল ক্যারিয়ারে নিজের ১৫০তম ছক্কার মাইলফলক স্পর্শ করেন আইয়ার। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে ছাড়িয়ে পাঞ্জাবের হয়ে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ছক্কা (৩৯টি) মারার রেকর্ডটিও এখন তাঁর।
এই এক ইনিংস নিশ্চয়ই কারও যোগ্যতা, সামর্থ্য বিচারের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই পাঞ্জাবের হয়ে আইয়ারের অভিষেক মৌসুমের খতিয়ান তুলে ধরা যাক। ১৬ ইনিংসে করেছেন ৬০৬ রান, শীর্ষ ১০ রান সংগ্রাহকের তালিকায় ষষ্ঠ। পাঞ্জাবের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যান তিনিই। এই মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জেতা (১০) অধিনায়কও আইয়ার। পাওয়ারপ্লের পর ব্যাটিংয়ে নামাদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (শীর্ষে লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসের নিকোলাস পুরান) স্ট্রাইক রেট তাঁর।
গত কয়েক মাসে এই জায়গাতেই সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছেন আইয়ার। টি–টোয়েন্টি সংস্করণেও আগে থিতু হতে কিছুটা সময় নিতেন। কিন্তু তাঁর বোধোদয় হয়েছে, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আরও আগ্রাসী হতে হবে। এখন তাই শুরু থেকেই মেরে খেলছেন আইয়ার। ‘মাইরের ওপর ওষুধ নাই’ কথাটিকে যেন সার্থক করে তুলেছেন!
নিজেকে বদলে ফেলে শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করছেন আইয়ারছবি: এএফপি
তাই বলে খ্যাপাটে ষাঁড়ের মতো উল্টোপাল্টা কোনো শট নয়; ক্রিকেটীয় শটেই বাড়তি শক্তি প্রয়োগ করে ফুটিয়ে তুলছেন মাঠে। যার কোনোটি ফাইন লেগের ওপর দিয়ে আছড়ে পড়ছে গ্যালারিতে, কোনোটি আবার লং অন–লং অফের ওপর দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে।
বাড়তি গুণ হিসেবে যোগ হয়েছে খেলাকে বোঝা। সহজ ভাষায় বললে, ঝোপ বুঝে কোপ মারা। কালকের ম্যাচটির কথাই ধরুন। পাঞ্জাবের জয় ও পরাজয়ের মাঝে দেয়াল তুলে দাঁড়াতে পারতেন শুধু বুমরা। যে ভূমিকায় তাঁকে বেশির ভাগ সময় দেখা যায়। এ কারণেই কি না বুমরার শেষ ওভারের দ্বিতীয় বলেই বাউন্ডারি পেয়ে যাওয়ায় আর ঝুঁকি নেননি আইয়ার। তবে সেটা করতে গিয়ে জয়ের জন্য পাঞ্জাবের প্রয়োজনীয় রান রেট ১১ ছাড়িয়েছিল।
কিন্তু আত্মবিশ্বাস থাকলে যা হয় আরকি! আইয়ার ছিলেন অনভিজ্ঞ অশ্বিনি কুমারের অপেক্ষায়। ১৯তম ওভারে অশ্বিনিকেই বোলিংয়ে আনেন মুম্বাই অধিনায়ক হার্দিক পান্ডিয়া। ব্যস, আইয়ারকে আর থামায় কে? ৪ ছক্কায় খেল খতম!
প্রীতির উচ্ছ্বাস আর আইয়ারের নির্লিপ্ততা
দলের সবাইকে আগলে রাখেন প্রীতি জিনতাছবি: এক্স
দল ১১ বছর পর ফাইনালে ওঠায় সদা হাস্যোজ্জ্বল প্রীতি জিনতার স্বাভাবিকভাবেই আনন্দের আতিশয্যে ভেসে যাওয়ার কথা। প্রীতিকে কাল উচ্ছ্বাস একটু বেশিই পেয়ে বসেছিল। সামনে দলের যাঁকে পেয়েছেন, তাঁর সঙ্গেই আলিঙ্গন করে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
তবে একটি মুহূর্ত আলাদা করে সবার নজরে এসেছে, যেটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছে। কাল পাঞ্জাব ফাইনালে ওঠার পর দলের এক খেলোয়াড়ের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মারেন প্রীতি। এর অর্থ হয়তো গোপন কোনো বোঝাপড়া কিংবা বাজি ছিল, ‘তোমাকে বলেছিলাম না, আমরাই ফাইনাল খেলব!’
অধিনায়ক আইয়ারের অমন ইনিংস দেখার পর তাঁকে একটু বাড়তি সময় দিয়েছেন প্রীতি। আলিঙ্গন, পিঠ চাপড়ে দেওয়া, এরপর কিছু প্রশংসাসূচক কথাবার্তা। কিন্তু আইয়ার ছিলেন একেবারেই নির্লিপ্ত যেন মাঠে কিছুই করেননি! বোঝা যাচ্ছিল, প্রীতি আনন্দের বহিঃপ্রকাশ এভাবেই ঘটাতে ভালোবাসেন আর আইয়ার তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন মনে মনে।
তবে ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক আর তাঁর দলের অধিনায়কের এই সাফল্যের পেছনের গল্প তো প্রায় এক। পরিশ্রম, ধৈর্য ও হাল না ছাড়ার মানসিকতার প্রদর্শনীতে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।
পন্টিং-আইয়ার যুগলবন্দী ও আইয়ারের প্রত্যাবর্তন
রিকি পন্টিংকে পাঞ্জাব কিংসের প্রধান কোচের দায়িত্ব দিয়ে ভুল করেননি প্রীতি জিনতাবিসিসিআই
২০০৮ সালে আইপিলের পথচলা শুরুর সময় থেকেই খেলে যাচ্ছে প্রীতি জিনতার পাঞ্জাব কিংস। ভাগ্য বদলাতে ২০২১ সালে নামও বদলে ফেলা হয়। কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব থেকে হয় পাঞ্জাব কিংস। তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না।
এবার কিংবদন্তি রিকি পন্টিংকে প্রধান কোচের দায়িত্ব দিয়ে পাঞ্জাবের চেহারা খোলনলচে বদলে ফেলেছেন। দলকে ঢেলে সাজাতে মেগা নিলামে গিয়েছিলেন রেকর্ড ১১০ কোটি ৫০ লাখ রুপি নিয়ে।
আইয়ারকে কিনেছিলেন ২৬ কোটি ৭৫ লাখ রুপিতে। যে আইয়ারের নেতৃত্বের ভিত পন্টিংইয়েরই গড়ে দেওয়া। পন্টিং–আইয়ার যুগলবন্দীতেই ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো আইপিএলের ফাইনালে উঠেছিল দিল্লি ক্যাপিটালস। তাঁদের রসায়ন আরও জমে উঠেছে পাঞ্জাবে।
পাঞ্জাব ফাইনালে ওঠার পর প্রীতির সঙ্গে আইয়ারের সেলফিছবি: বিসিসিআই
কিন্তু এই আইয়ারও প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিলেন। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে অনীহা দেখানোয় গত বছরের শুরুর দিকে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ পড়েন।
আইয়ারের ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু এরপরই। এরপর রাজ্য দল মুম্বাইয়ের হয়ে জিতেছেন রঞ্জি ট্রফি। সেই মুম্বাইকেই নেতৃত্ব দিয়ে জিতিয়েছেন সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি। ১০ বছর পর কলকাতা নাইট রাইডার্স আইপিএলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তাঁরই অধিনায়কত্বে।
এখানেই শেষ নয়। মুম্বাইয়ের হয়ে ইরানি কাপ জিতে বছর শেষ করেছেন। এ বছর ভারতের আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়েও বড় অবদান রেখেছেন। হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং দলের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। এসবের পুরস্কার হিসেবে এ বছর বিসিসিআই আবারও তাঁকে কেন্দ্রীয় চুক্তিতে ফিরিয়েছে। আর এখন তাঁকে ভারতের ভবিষ্যৎ অধিনায়ক ভাবা হচ্ছে।
ফাইনালের অপেক্ষা
আইপিএল ইতিহাসের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে ভিন্ন তিন দলকে ফাইনালে তুলেছেন শ্রেয়াস আইয়ারছবি: এক্স
দিল্লি, কলকাতার পর পাঞ্জাব—তিনটি ভিন্ন দলকে নেতৃত্ব দিয়ে যিনি আইপিএলের ফাইনালে তুলতে পারেন, তাঁর মধ্যে নিশ্চয় বিশেষ কিছু আছে!
পাঞ্জাব, প্রীতি আর আইয়ারের এখন আর এক ধাপ পেরোনোর বাকি। আগামীকাল আহমেদাবাদে ১৮তম আসরের ফাইনাল শেষে আইপিএল পাবে নতুন চ্যাম্পিয়ন। আইয়ারদের প্রতিপক্ষ বিরাট কোহলির রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুও যে কখনো ট্রফির ছোঁয়া পায়নি!
গত বৃহস্পতিবার এই বেঙ্গালুরুর কাছেই প্রথম কোয়ালিফায়ারে বিধ্বস্ত হওয়ার পর আইয়ার বলেছিলেন, ‘আমরা একটা লড়াইয়ে হেরেছি, যুদ্ধে হারিনি।’ আর কাল বেঙ্গালুরুর সঙ্গেই শিরোপার লড়াই নিশ্চিত করার পর বলেছেন, ‘এমন চাপের মুহূর্তই আমি উপভোগ করি।’
আগামীকাল আইপিএলের ফাইনালে কোহলির বেঙ্গালুরুর মুখোমুখি হবে আইয়ারের পাঞ্জাবছবি: রয়টার্স
সেই উপভোগের মন্ত্র নিয়েই কাল যুদ্ধ জিততে দলবল নিয়ে আহমেদাবাদের রণাঙ্গনে নামবেন আইয়ার। প্রীতির পাঞ্জাব জিততে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয় তো তাঁর দল অনেক আগেই জিতে নিয়েছে!