
ইলন মাস্কের মালিকানাধীন নিউরোটেকনোলজি কোম্পানি নিউরালিঙ্ক (Neuralink) একটি যুগান্তকারী প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে, যা মানুষের মস্তিষ্ককে সরাসরি কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত করবে। এই প্রযুক্তি, যাকে ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (BCI) বলা হয়, মানুষের চিন্তাভাবনা, গতিবিধি এবং সংবেদনশীলতাকে ডিজিটাল সংকেতে রূপান্তরিত করার লক্ষ্য রাখে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো স্নায়বিক রোগের চিকিৎসায় সহায়তা করা, মানুষের সক্ষমতা বাড়ানো এবং ভবিষ্যতে মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) সাথে আরও নিবিড়ভাবে সংযুক্ত করা।
নিউরালিঙ্ক কীভাবে কাজ করে?
নিউরালিঙ্কের মূল প্রযুক্তি হলো একটি ক্ষুদ্র চিপ (Chip), যা সার্জারির মাধ্যমে মস্তিষ্কে স্থাপন করা হয়। এই চিপে অত্যন্ত পাতলা এবং নমনীয় ইলেকট্রোড তার (Electrode Threads) থাকে, যা মস্তিষ্কের নিউরন থেকে বৈদ্যুতিক সংকেত রেকর্ড করে। এই সংকেতগুলি নিউরালিঙ্ক অ্যাপ্লিকেশনে ওয়্যারলেসভাবে স্থানান্তরিত হয়, যেখানে সেগুলিকে ডিকোড করে কম্পিউটার বা মোবাইল ডিভাইসের কমান্ডে পরিণত করা হয়।
নিউরালিঙ্কের এই চিপটি ‘টেলিপ্যাথি’ নামে পরিচিত এবং এটি মানুষের মস্তিষ্কের সেই অংশে স্থাপন করা হয় যা মোটর ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে, ব্যবহারকারী কেবল চিন্তার মাধ্যমেই ফোন, কম্পিউটার বা অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে।

বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
নিউরালিঙ্ক ইতিমধ্যেই পশুদের (যেমন বানর এবং শূকর) উপর সফলভাবে চিপ পরীক্ষা চালিয়েছে। এই পরীক্ষাগুলোতে দেখা গেছে যে বানরগুলো চিপের সাহায্যে কম্পিউটার স্ক্রিনে কার্সার সরাতে বা ভিডিও গেম খেলতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি, নিউরালিঙ্ক মানুষের মস্তিষ্কে প্রথম চিপ প্রতিস্থাপনের অনুমতি পেয়েছে এবং সফলভাবে কয়েকজন রোগীর উপর পরীক্ষা চালিয়েছে।
প্রাথমিক ফলাফল বেশ উৎসাহব্যঞ্জক। মাস্ক দাবি করেছেন যে, যারা মেরুদণ্ডের আঘাতের কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, তাদের মতো রোগীরা নিউরালিঙ্কের চিপের মাধ্যমে কেবল চিন্তা ব্যবহার করে কম্পিউটার মাউস নিয়ন্ত্রণ করতে এবং দাবা খেলতে সক্ষম হচ্ছেন।
ভবিষ্যতে, নিউরালিঙ্ক আরও উন্নত সংস্করণ আনার পরিকল্পনা করছে, যেমন ‘ব্লাইন্ডসাইট’ নামক একটি যন্ত্র যা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে। যদিও শুরুর দিকে কম রেজ্যুলেশনের দৃশ্য দেখা যাবে, সময়ের সাথে সাথে এটি মানুষের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তির চেয়েও উন্নত হয়ে উঠতে পারে। নিউরালিঙ্কের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হলো মানুষের মস্তিষ্কের সক্ষমতা বাড়ানো, স্মৃতিশক্তি উন্নত করা, টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ সম্ভব করা এবং স্নায়বিক সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের চলাফেরা ও যোগাযোগের ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা।
সম্ভাব্য সুবিধা ও ঝুঁকি
সুবিধা:
- রোগ নিরাময়: পক্ষাঘাত, পারকিনসন্স, আলঝেইমার, মৃগীরোগ এবং অন্যান্য স্নায়বিক রোগের চিকিৎসায় এটি একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে।
- বর্ধিত সক্ষমতা: এটি মানুষের শেখার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি এবং যোগাযোগের দক্ষতা বাড়াতে পারে।
- কম্পিউটারের সাথে সরাসরি ইন্টারঅ্যাকশন: শুধুমাত্র চিন্তার মাধ্যমে ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমাদের দৈনন্দিন কাজকে আরও সহজ করে তুলবে।
- যোগাযোগের নতুন মাত্রা: যারা কথা বলতে অক্ষম, তাদের জন্য এটি যোগাযোগের একটি নতুন পথ খুলে দেবে।
ঝুঁকি:
- নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা: মস্তিষ্কে চিপ স্থাপন হ্যাকিং এবং ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহারের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
- স্বাস্থ্য ঝুঁকি: সার্জারি এবং চিপ প্রতিস্থাপনের দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক প্রভাব নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে।
- নৈতিক প্রশ্ন: মানুষের মস্তিষ্কের পরিবর্তন, সামাজিক বৈষম্য এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন নৈতিক প্রশ্ন উঠে আসে।
- প্রযুক্তির অপব্যবহার: এটি মানসিক নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে এমন আশঙ্কাও রয়েছে।
নিউরালিঙ্ক একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি, যা মানবজাতির জন্য অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি করতে পারে। তবে এর সফল বাস্তবায়ন এবং নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য গবেষণা, নিয়ন্ত্রণ এবং নৈতিক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।