আজমিরীগঞ্জের জলসুখা গ্রাম যেন এক নীরব ইতিহাস ধারণ করে আছে। প্রায় আড়াইশ বছর আগের ১৪টি জমিদার বাড়ি কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে থাকলেও, অযত্ন আর অবহেলায় তাদের জৌলুস আজ মলিন। স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের দখলের থাবা পড়েছে অধিকাংশ বাড়িতেই। স্থানীয়দের অভিযোগ, জোরপূর্বক এবং ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে অনেকেই এসব ঐতিহাসিক সম্পত্তির মালিকানা নিজেদের করে নিয়েছে। অন্যদিকে, কিছু জরাজীর্ণ বাড়ি পরিণত হয়েছে মাদকসেবী ও জুয়াড়িদের আখড়ায়।

এই ১৩ জন সনাতন ধর্মাবলম্বী জমিদারের মধ্যে বর্তমানে জীবিত আছেন কেবল একজন উত্তরাধিকারী, কমলেশ রায়। নব্বইয়ের কোঠায় পৌঁছেছেন তিনি। ১৪ জন জমিদারের মধ্যে ক্ষেত্রনাথ রায়ের নাতি কমলেশ রায় তার বাবার জমিদারীর কিছুটা অংশ ভোগ করলেও, পরিণত বয়সে এসে প্রায় নিঃস্ব জীবনযাপন করছেন। অন্যরা দেশ ছেড়ে গেলেও, এই জন্মভিটার টানে তিনি আজও বাংলাদেশে রয়ে গেছেন। তার শেষ ইচ্ছা, পৈতৃক ভিটেতেই যেন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন।
অথচ আশ্চর্যের বিষয়, এই জমিদার বাড়িগুলো নিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোনো ঐতিহাসিক জ্ঞান নেই। হাতেগোনা কয়েকজন সামান্য কিছু তথ্য জানেন।
তবে প্রবীণ মুরুব্বি হাজি আবদুল হাসিম এক মূল্যবান তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানান, ১৮ শতকের কোনো এক সময়ে ব্রিটিশ আমলের প্রভাবশালী অফিসার লর্ড ক্লাইভ জলসুখার জমিদার বৈকন্ঠ রায়ের বাবা দোল গোবিন্দের আমন্ত্রণে তাদের বাড়িতে এসেছিলেন এবং এক রাত সেখানে যাপন করেছিলেন। সেই সময় জমিদার দোলগোবিন্দ লর্ড ক্লাইভের আপ্যায়নে প্রায় লক্ষাধিক টাকা খরচ করেছিলেন। শিল্পীরা গেয়ে শুনিয়েছিলেন বিখ্যাত ঘাটুগান। এই ঘটনা থেকেই তৎকালীন জমিদারদের প্রাচুর্য এবং উচ্চশিক্ষার পরিচয় পাওয়া যায়।
ঘাটুগানের প্রচলন যে ১৮ শতক থেকেই, তার প্রমাণ পাওয়া যায় মরমি সাধক বাউল শাহ আবদুল করিমের গানেও। এমনকি বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ুন আহমেদ জলসুখার এই জমিদারদের জীবনকাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ করেছিলেন “ঘেটুপুত্র কমলা” সিনেমাটি।
এত চমকপ্রদ ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও, জলসুখার জমিদার বাড়িগুলো আজও স্থানীয়দের কাছে অজানা। এ নিয়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য লেখালেখিও হয়নি। এমনকি গুগল খুঁজেও এই জমিদার পরিবার সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় না। যা কিছু সামান্য লেখালেখি হয়েছে, তা এই সমৃদ্ধ ইতিহাসের তুলনায় খুবই নগণ্য। ফলে, জলসুখার এই গৌরবময় ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অজানাই থেকে যাচ্ছে। তারা জানতে পারছে না তাদের অঞ্চলের প্রকৃত ইতিহাস। ইতিহাস চর্চারও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।

তাই স্থানীয় সচেতন মহলের জোর দাবি, অবিলম্বে এই দখলকৃত জমিদার বাড়িগুলোকে অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে উদ্ধার করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে আনা হোক। এর ফলে একদিকে যেমন এই প্রজন্ম তাদের শিকড়ের সন্ধান পাবে, তেমনি অন্যদিকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমনে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতিও ঘটবে, সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থানের।
তবে আশার আলো এখনও নিভে যায়নি। ১৪টি জমিদার বাড়ির মধ্যে চারটি এখনও তাদের কিছু উত্তরাধিকারীর তত্ত্বাবধানে রয়েছে। স্থানীয় সচেতন মহল মনে করে, এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলোকে যদি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে এনে সংস্কার করা যায়, তবে তারা শুধু পর্যটকদের কাছেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও জীবন্ত ইতিহাস হিসেবে টিকে থাকবে। মানুষ জানতে পারবে এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ অতীত।
আজমিরীগঞ্জের এই ১৪ জন জমিদারের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং একজন ছিলেন মুসলমান। মুসলমান জমিদারের নাম ছিল রমজান আলী চৌধুরী, যিনি বুছা মিয়া চৌধুরী নামেও পরিচিত ছিলেন। বাকি ১৩ জন সনাতন ধর্মাবলম্বী জমিদার ছিলেন চন্দ্র কুমার রায়, কৃষ্ণ কুমার রায়, সূর্যমনি রায়, বৈকন্ঠ নাথ রায়, শরৎ চন্দ্র রায়, ভারত চন্দ্র রায়, নন্দ লাল রায়, গোবিন চন্দ্র রায়, সতীশ চন্দ্র রায়, ক্ষেত্রনাথ রায়, লক্ষীকান্ত রায়, মাধব চন্দ্র রায় এবং রমা বল্লব রায়। এই জমিদারদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে প্রবীণ বা দায়িত্ববান ছিলেন, তাঁকেই খাজনা আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হতো।
ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর অধিকাংশ জমিদার তাদের জমিদারি ফেলে ভারতে চলে যান। সেই সুযোগে তাদের সম্পত্তি বেদখল হতে শুরু করে এবং স্থানীয় প্রভাবশালী মুসলমানদের দখলে চলে যায়। যদিও কিছু জমিদারের বংশধর এখনও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করেন, স্থানীয়রা তাদের আগমন তেমন একটা দেখেনি।
জলসুখার বাসিন্দা মোঃ রঙ্গু মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, একসময় দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক এই জমিদার বাড়িগুলো দেখতে আসতেন। কিন্তু আজ জরাজীর্ণ অবস্থায় পরিত্যক্ত থাকায় তেমন আর কেউ আসেন না।

সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক আতাউর রহমান এই বাড়িগুলো দ্রুত সংস্কার ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় আনার দাবি জানান।
লেখক ও গবেষক আবু সালেহ আহমেদ জানান,
জলসুখার জমিদার বাড়িগুলো নিয়ে তার অনেক গবেষণা রয়েছে এবং এ বিষয়ে তিনি বহু লিখেছেন। তিনি মনে করেন, এই বাড়িগুলো সংস্কার করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা অপরিহার্য।
লেখক ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ড. শেখ ফজলে এলাহি নিশ্চিত করেন যে ১৮ শতকে জলসুখায় ১৪ জন অত্যন্ত প্রভাবশালী ও শিক্ষিত জমিদার ছিলেন। সেই সময় বরাক উপত্যকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ জলসুখা গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা দেশ-বিদেশেও আলোচিত হয়েছিল। এছাড়াও, এই জমিদাররা ছিলেন দেশপ্রেমিক। তাদের দেশপ্রেম ছিল অনুকরণীয়। তিনিও এই বাড়িগুলো সংস্কার করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে নেওয়ার পক্ষে মত দেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক জয়ন্ত সিংহ রায় এই ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িগুলোকে ইতিহাসের অমূল্য অংশ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই স্থাপনাগুলোকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে আনার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়ে আসছেন।
আজমিরীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বক্তব্য জানার জন্য তার সরকারি মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি এবং হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
জলসুখার এই ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িগুলো শুধু কয়েকটি ইটের স্তূপ নয়, এগুলো আমাদের ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। এদের সংরক্ষণ করা শুধু বর্তমান প্রজন্মের দায়িত্ব নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ইতিহাসকে তুলে ধরারও অপরিহার্য কর্তব্য।