সিলেট ০৪:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫
News Title :
‎টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে ঐতিহ্যবাহী ধুয়া গানের পুনরুজ্জীবন: ইউনুস বয়াতি ও ওয়াসিম বয়াতির মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা ‎এসএসসি পরীক্ষার্থী জনি দাস হত্যা: আসামি সাজু মিয়া ৩ দিনের রিমান্ডে, জনতার উত্তম-মধ্যম ‎সিলেটে বিপণীবিতানগুলোতে ইচ্ছেমতো পার্কিং ফি আদায়, ক্ষুব্ধ নগরবাসী। ‎নবীগঞ্জে ভয়াবহ সংঘাত: জনমনে প্রশ্ন, দাবি শান্তির বাংলাদেশ পুলিশের আইজিপি শিক্ষা বৃত্তি-২০২৪ প্রদান: সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের সফল আয়োজন । ‎গুপ্ত টি হাউজ: শ্রীমঙ্গলের এক বিশ্বস্ত নাম পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে শিক্ষকদের অনীহা, সমাধানে করণীয়! সবুজের ছায়ায় লাল-সবুজের খোঁজে:‎লক্ষ্মীবাওড় জলাবন গোয়াইনঘাটে অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে লেঙ্গুড়া গ্রামবাসীর কঠোর হুঁশিয়ারি। সিলেট জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার কাজী মাহবুব উর রহমানকে ছাড়পত্র: নতুন কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ।

“বয়েস”

  • মঞ্জিমা
  • সময় ০৪:০৯:৩৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫
  • 62

বরোষা তখন ঘুড়ির সুতো বেয়ে গড়িয়ে নামছে উঠানে। কুকুরটা কাঁদছে ভোর ইস্তক। বেহুলার সেতুর সঙ্গী কুকুরটা মরে পড়ে আছে। ঘাড়ে কামড় খেয়েছিল বিচ্ছিরিভাবে। ঘাড়টা ফুলে উঠেছে মাথার নিচে বালিশের মতো। ওদিকে কাত করেই মরে পড়ে আছে। বেহুলার পাশে ধানজমির হাঁটুসমান সবুজের ভিতরে ফুটে আছে সাদা শালুক। কালচে সবুজ রাতের আকাশে অনবদ্য সব তারা।
সাইকেলটা এবার সারাতেই হয়। লজ্জার অবস্থা। আলের মাটিতে বসে যাচ্ছে অথচ ঠিকভাবে চাকায় হাওয়া দেওয়া যাচ্ছে না এমন অবস্থা টিউবের। শাপলা ডাঁটার আজকাল চাহিদা বেড়েছে ভালোই। সারাদিন তিনবেলা খেতে পারছে বাড়ির সবকটা লোক শাপলা ডাঁটার বদৌলতে। সাইকেলে ডাঁটা তুলে প্রসাদ রোজ ভোরে যায় কুসুমগ্রামের হাটে।
কুসুমগ্রামের হাট। রেলরাস্তার পাশে ভোর থেকে জেগে উঠতে থাকে। শাকে,সবজিতে,হাঁসের ডিমে, কচ্ছপের মাংসে, বাজারের থলে হাতে মানুষে আর হাটুরেতে ভরে যায় হাট। দামোদরের টাটকা সবজি আর মাছের জলের কাদার ছিটে ছিটকে আসে প্রসাদের শাপলায়। আপ লোকাল ডাউন লোকাল মাটি কাঁপিয়ে যাতায়াত শুরু করে। সোম থেকে শনি রোজ সকালে হাট পেরিয়ে ইশকুলে যায় ছোট্ট একটা পুতুল। বাবার সঙ্গে হেঁটে যায় ইশকুলে। প্রসাদের কাছে তার আবদার একটি করে শাপলাফুলের। সে তার দিদিমনিকে দেবে।
পুতুলের মতোন ফুটফুটেটা প্রসাদের সামনে এসে একদিন বললো ,”একটা ফুল দাও তো। মালিনী ম্যাডামকে দেবো। ” প্রসাদ প্রথমটা বোঝে নি। তার কাছে কেউ ফুল চায় না। ফুটফুটের বাবা থ ভাব দেখে বললেন, ”একটা ফুল দাও ভাই, কাল বাংলা ক্লাসে কবিতায় পড়েছে শাপলা ফুলের কথা। আমাকে জিজ্ঞেস করলো এইটা কী ফুল, বললাম শাপলা। অমনি তার ম্যাডামের জন্য নিয়ে যাওয়া চাই।” ফুটফুটের বাবা বেশ জমাটি লোক। কথার ধরণে হেসে ফেললো প্রসাদ। ফুল দিলো। দাম দিতে চাইলে নিলো না। এই ফুলের দাম সে জানে না। ফুল বিক্রি করার কথা সে ভাবে নি। কাদায় পড়ে থাকা ফুলের দাম ঠিক করতে পারে না প্রসাদ। বরং তার ভালো লাগে ফুল দিতে। এখন রোজ ফুল তুলে রাখে মালিনীর জন্য। ইস্, মালিনী ম্যাডামের জন্য।
প্রসাদ খুব বেশি একটা দিন ইশকুলে যেতে পারে নি প্রসাদ। চাল আনতে যায়, অথবা পরীক্ষা থাকলে। এখন তো সে পাটও চুকেছে। ভাই বোনেরা যায়, চালটাল ওরাই আনে। প্রসাদকে কাজে বেরোতে হয়। সকালে শাপলা বেচে সে যাবে বড়পাড়ার বইয়ের দোকানে। দশটা বাজলে একবাটি মুড়ি আর আদ্ধেক পেঁয়াজ ওর দিনের বেলার খোরাকি। দুপুরে বাড়ি গিয়ে শাপলা বিলে স্নান করে কুচো মাছ পেলে নিয়ে আসে গামছায় ভরে। এক দুটো পড়ে সবার ভাগে। নয়তো নুন আর গরম ভাত। এনামেলের বাটিতে ফ্যান গরম গরম। খেয়ে দেয়ে সাইকেলটা নিয়ে আবার বড়পাড়া। বইয়ের দোকান। ছোটভাইটার ব্লাড ক্যান্সার। সবাই জানে সে বাঁচবে না। কিন্তু যদ্দিন আছে তদ্দিন হু হু করে টাকা বেরোচ্ছে তার পিছনে। বাবার ট্রেনে হকারির টাকা, তার বইয়ের দোকানের মাইনে, মায়ের জমিতে কাজের টাকা সব দিয়েও তার চিকিৎসার কিছুই প্রায় জোগাড় করতে পারে না প্রসাদরা। শুকিয়ে দড়ির মতো হয়ে পড়ে আছে ছোটন। প্রসাদের ভাই। ভালো নামটা আর কেউ ডাকে না, ইশকুলে ভর্তি হয় নি তো। ওই নামটা জন্মের কাগজে কেবল আছে। প্রশান্ত। প্রশান্ত ক্ষেত্রপাল।
মালিনীকে ফুল দেওয়া রোজকার এক আনন্দ হয়েছে প্রসাদের। জল থেকে সুতোর মতো আলোফোটা ভোরে সে প্রথম ফুলটা তোলে মালিনীর জন্য। সে কে, কেমন দেখতে, কোথায় থাকে কিছুই জানে না প্রসাদ। শুধু জানে কুসুমগ্রামের ইশকুলে সে বাংলা পড়ায়। কবিতা পড়ায়। অরবিন্দ স্যারের মতো, রঘুবাবুর মতো। বাংলা পড়ায়। প্রসাদের খুব ইচ্ছে তাকে দ্যাখে। কিন্তু ভাঙা সাইকেলে গিয়ে শাপলার ডাঁটা বিক্রি করার লজ্জা নিয়ে মালিনীকে দেখতে যেতে পারে না প্রসাদ। তাকে সে যতই মালিনী ডাকুক মনে মনে, সে তো মালিনী ম্যাডাম। শাপলার কবিতা পড়ায় সে। আর প্রসাদ কিনা শাপলা বেচতে যায়। কোন সাহসে তার দেখা পেতে যাবে প্রসাদ? মানায় না। সবটা সবাইকে মানায় না।
প্রসাদ কবিতা পড়তে ভালোবাসতো‌। গল্পের চেয়েও বেশি। অরবিন্দ স্যার কী সুন্দর পড়তেন কবিতা। বলতেন, কবিতা লেখা সবার কম্ম নয়, কবিতা বোঝাও সবার নয় কম্ম। প্রসাদ কি সব বোঝে? তবু পড়তে ভালো লাগে কবিতা। মালিনী কবিতা পড়ায়। মালিনী শাড়ি পরে। মালিনীর হাত ছুঁয়ে থাকে শাপলা। কুসুমগ্রামের মালিনী ম্যাডামের পায়ের কাছে এসে বসে থাকে চুপ করে থাকা কিশোরটির সাধের বেলা।
“বইটি আমার খুবই প্রয়োজন।‌ আপনারা এনে দিতে পারবেন শুনে এসেছি। চেষ্টা করবেন।‌ এলে আমাকে জানাবেন। আমার স্কুলের নম্বর দিয়ে যাচ্ছি। একটা ফোন করে দেবেন। বলবেন, মালিনী সেনগুপ্তর বই এসেছে। ওনাকে বলে দিতে।” ” আপনার কোন স্কুল ম্যাডাম?” “কুসুমগ্রাম…” “ও, আপনার তাহলে কোনো চিন্তা নেই। এই ছেলেটি রোজ যায় আপনার স্কুলের পাশেই। ও দিয়ে আসবে।” প্রসাদ থ হয়ে দেখছে তখন। সরস্বতী সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কুসুমগ্রামের মালিনী ম্যাডাম। ওর মালিনী। শাপলা ফুল দিয়ে রোজ যাকে ছোঁয়। মালিনী ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, “বাবু তুমি পারবে তো চিনতে? দিয়ে আসতে পারবে? বলবে মালিনী ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করবো। কেমন? বইটা এলেই দিয়ে এসো। ঠিক আছে?” হাঁ করা মুখটা চোখ নামিয়ে ফেলেছে প্রসাদের। এখন ওর কান্না পাচ্ছে। মাথাটা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে পিছনের তাকের দিকে ঘুরে বইপত্র নাড়তে থাকে প্রসাদ। বড়স্যার বলে “ও ওমনি লাজুক ম্যাডাম। কথা বলতে পারে না কারোর সঙ্গে। ও ঠিক পৌঁছে দেবে। আপনি নিশ্চিত থাকুন চার পাঁচ দিনের মধ্যে বই পেয়ে যাবেন হাতে।”
ভাঙা সাইকেলের কেরিয়ারে বাঁধা শাপলা ডাঁটা। বুকের কোনাকুনি ব্যাগের দড়ি। পাটের সুতোর বস্তা কেটে বানানো ব্যাগে খবরের কাগজে মোড়ানো মালিনীর বই। সুতলি দড়ির মধ্যে ঢোকানো রয়েছে রশিদ‌। একহাজার সাতশো আটান্ন টাকা। মালিনী কত দামী বই পড়ে। মালিনী তার চেয়ে কত গুণ টাকা বেশি রোজগার করে ভাবতেই কেমন চোখ জ্বালা করে প্রসাদের। দামী খদ্দেরকে বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য একবেলা ছুটি পেয়েছে প্রসাদ বইয়ের দোকানে। ফুটফুটেটা ফুল নিয়ে গেছে একটু আগেই। শাপলা বিক্রি হয়ে গেছে ওর। এখন কুসুমগ্রামের ভাঙা হাট ছেড়ে রেলের রাস্তার ডিঙিয়ে মাঠের পাশে ধাবিতে বসে আছে প্রসাদ। কত কী নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে মালিনীর জন্য। অথচ নিয়ে যাওয়া ভালো দেখায় না। শাপলা বেচে তার কাছে নগদ টাকা একশো আশি। বেশি করেই শাপলা এনেছিল আজ। যদি কিছু কিনে দিতে ইচ্ছে করে ওর। ধুর। গরীব প্রেমিকের জ্বালা অনেক। কিনে দেওয়ার ক্ষমতা বা এক্তিয়ার কোনোটাই ওর নেই। আর মালিনী যদি বিষয়টা ভালো চোখে না দ্যাখে বইয়ের দোকানে চাকরিটাও যেতে পারে। প্রসাদ শক্ত হয়। কীসব ভাবছে। ভাইটার কথা ভুলে গেল নাকি। স্কুল খুলতে এখনো বেশ দেরি। চোখের নিচে কাদামাখা শিশিরের মতো ঘাম আর কান্নার ফোঁটা জমেছিল ওর। দু আঙুলে ওই জলটুকু নিয়ে বইমোড়ানো কাগজটায় মাখিয়ে দেয় প্রসাদ। ওর ইচ্ছে যাক, বিষাদ যাক, শরীরের মধু যাক, কাজের জবরদস্তি যাক মালিনীর কাছে। ছুঁয়ে দেখুক মালিনী ওর শরীরের কেমন স্বাদ, ওর জীবনের কেমন জট, ওর রোজকার কেমন এলোমেলো নিয়ে ও বসে আছে একহাজার সাতশো আটান্ন টাকার পাশে।
ইশকুলে ক্লাস শুরুর ঘন্টা বাজলো। প্রসাদ দাঁড়িয়ে আছে গেটে। মালিনী ম্যাডাম আসবেন ক্লাসটা শেষ করেই। কতদিন পর ইশকুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রসাদ। এতদিনে ওর ক্লাস ইলেভেন হওয়ার কথা। সে জানে তার বয়েস আরো বেশি। তার কাম জাগে না, সে প্রেমে ভয় পায়।‌ তার খিদে পায় না, পেলেও ভাইবোনের মুখে তাকিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে। তার ঘুম আসার আগে গরাদগলা চাঁদের আলোয় নেশা লাগে না। গোপন অঙ্গকে গোপনে ঘুমোতে শিখিয়েছে ও।‌ আশপাশে এক বিছানায় সব শোয়। ওর বয়েস হয় নি তো আর কার হয়েছে! ভালোবাসা ওকে অভিমানী করেছে। মালিনীকে দেখা ইস্তক মনখারাপের খাদে পড়ে গেছে ও। স্পষ্ট করে বুঝতে পেরেছে শুধু টাকা কুড়িয়ে বাড়িয়ে থাকার একটা দুর্লভ জন্ম পেয়েছে সে। তাকে পড়াশোনা করতে হবে না।‌তাকে প্রেম করতে হবে না। বিয়ের কথাও বলবে না কেউ খরচ ভাগাভাগি হয়ে যাবে বলে। “এসে পড়েছো? দাঁড়িয়ে আছো না অনেকক্ষণ? এসো ভিতরে এসো।” প্রসাদ মালিনীর দিকে তাকিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ। বললো, “না, ইশকুলের ভিতরে আর যাবো না। আমি ছাত্র নই, মাস্টারও নই।” “কিন্তু তুমি যে তাকে ছাড়া তো স্কুল চলবেই না। আচ্ছা চলো মাঠে চলো। কী খাবে বলো? কুলের আচার? সকাল থেকে খেয়েছো কিছু?” “আমাকে ছাড়া ইশকুল চলবে না কেন?”, প্রসাদ জিজ্ঞেস করলো। “বই। তুমি বই বিক্রি করো। বই নিয়ে এসেছো। তোমাকে ছাড়া স্কুল চলবে কেমন করে শুনি? এই কত টাকা হয়েছে? দাও তো দেখি।” প্রসাদ বইটা এগিয়ে দিল। ওর কান্না গেল ওর ঘাম গেল। বললো, “আমি কিন্তু ফুল বেচি না, তবে সেও আসে ইশকুলে।” মালিনী তখন সারামুখে আনন্দ নিয়ে বই দেখছে। প্রসাদের কথা বোধহয় কানে যায় নি। এক হাজার আটশো টাকা ওর হাতে দিয়ে বললো, “বাকিটা ফেরত দিতে হবে না। ওটা দিয়ে কিছু কিনে খেও।” “আপনি কিন্তু আমাকে একটা বই দিতে পারতেন মালিনী ম্যাডাম। আসছি।” বলে একবিন্দু দেরি না করে সাইকেলে উঠে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে প্রসাদ। পিছনে থাকলো ঘাম, বিষাদজল। ভাঙা সাইকেলে বকশিস সমেত টাকা নিয়ে ফিরছে প্রসাদ। বিষাদবালক। বিষাদবৃদ্ধ।
টাকাটা কাছে রাখতে পারলে ভালো হতো। মালিনীর স্পর্শ। কিন্তু তার কাছে অতখানি টাকা জমানো নেই। বড়স্যারকে দিতে হবে। দেয়ও। বকশিসটা জমা রাখতে বলে। মাইনের সঙ্গেই নেবে। প্রসাদ কাল থেকে সকালে মাছের আড়তে যাবে কাজ করতে। ভোরবেলা মাছ তোলা থেকে সকালের প্রথম প্রহরটুকু প্রচুর মজুর লাগে খেলেডাঙার মাছের আড়তে। বরফ ভাঙার কাজ নিয়েছে আজ দুপুরে কথা বলে এসেছে প্রসাদ। জলেরই তো দুটো প্রাণ। মাছ আর শাপলা। থাক ইচ্ছে। যাক ইচ্ছে। গুলিয়ে উঠুক খালি পেটের সকাল। মাছের আড়তে মালিনীর গন্ধ নাক থেকে মুছে যাবে ধীরে ধীরে ঠিক।

লেখক-মঞ্জিমা
শান্তিনিকেতন, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।

ট্যাগস :
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

‎টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে ঐতিহ্যবাহী ধুয়া গানের পুনরুজ্জীবন: ইউনুস বয়াতি ও ওয়াসিম বয়াতির মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা

“বয়েস”

সময় ০৪:০৯:৩৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

বরোষা তখন ঘুড়ির সুতো বেয়ে গড়িয়ে নামছে উঠানে। কুকুরটা কাঁদছে ভোর ইস্তক। বেহুলার সেতুর সঙ্গী কুকুরটা মরে পড়ে আছে। ঘাড়ে কামড় খেয়েছিল বিচ্ছিরিভাবে। ঘাড়টা ফুলে উঠেছে মাথার নিচে বালিশের মতো। ওদিকে কাত করেই মরে পড়ে আছে। বেহুলার পাশে ধানজমির হাঁটুসমান সবুজের ভিতরে ফুটে আছে সাদা শালুক। কালচে সবুজ রাতের আকাশে অনবদ্য সব তারা।
সাইকেলটা এবার সারাতেই হয়। লজ্জার অবস্থা। আলের মাটিতে বসে যাচ্ছে অথচ ঠিকভাবে চাকায় হাওয়া দেওয়া যাচ্ছে না এমন অবস্থা টিউবের। শাপলা ডাঁটার আজকাল চাহিদা বেড়েছে ভালোই। সারাদিন তিনবেলা খেতে পারছে বাড়ির সবকটা লোক শাপলা ডাঁটার বদৌলতে। সাইকেলে ডাঁটা তুলে প্রসাদ রোজ ভোরে যায় কুসুমগ্রামের হাটে।
কুসুমগ্রামের হাট। রেলরাস্তার পাশে ভোর থেকে জেগে উঠতে থাকে। শাকে,সবজিতে,হাঁসের ডিমে, কচ্ছপের মাংসে, বাজারের থলে হাতে মানুষে আর হাটুরেতে ভরে যায় হাট। দামোদরের টাটকা সবজি আর মাছের জলের কাদার ছিটে ছিটকে আসে প্রসাদের শাপলায়। আপ লোকাল ডাউন লোকাল মাটি কাঁপিয়ে যাতায়াত শুরু করে। সোম থেকে শনি রোজ সকালে হাট পেরিয়ে ইশকুলে যায় ছোট্ট একটা পুতুল। বাবার সঙ্গে হেঁটে যায় ইশকুলে। প্রসাদের কাছে তার আবদার একটি করে শাপলাফুলের। সে তার দিদিমনিকে দেবে।
পুতুলের মতোন ফুটফুটেটা প্রসাদের সামনে এসে একদিন বললো ,”একটা ফুল দাও তো। মালিনী ম্যাডামকে দেবো। ” প্রসাদ প্রথমটা বোঝে নি। তার কাছে কেউ ফুল চায় না। ফুটফুটের বাবা থ ভাব দেখে বললেন, ”একটা ফুল দাও ভাই, কাল বাংলা ক্লাসে কবিতায় পড়েছে শাপলা ফুলের কথা। আমাকে জিজ্ঞেস করলো এইটা কী ফুল, বললাম শাপলা। অমনি তার ম্যাডামের জন্য নিয়ে যাওয়া চাই।” ফুটফুটের বাবা বেশ জমাটি লোক। কথার ধরণে হেসে ফেললো প্রসাদ। ফুল দিলো। দাম দিতে চাইলে নিলো না। এই ফুলের দাম সে জানে না। ফুল বিক্রি করার কথা সে ভাবে নি। কাদায় পড়ে থাকা ফুলের দাম ঠিক করতে পারে না প্রসাদ। বরং তার ভালো লাগে ফুল দিতে। এখন রোজ ফুল তুলে রাখে মালিনীর জন্য। ইস্, মালিনী ম্যাডামের জন্য।
প্রসাদ খুব বেশি একটা দিন ইশকুলে যেতে পারে নি প্রসাদ। চাল আনতে যায়, অথবা পরীক্ষা থাকলে। এখন তো সে পাটও চুকেছে। ভাই বোনেরা যায়, চালটাল ওরাই আনে। প্রসাদকে কাজে বেরোতে হয়। সকালে শাপলা বেচে সে যাবে বড়পাড়ার বইয়ের দোকানে। দশটা বাজলে একবাটি মুড়ি আর আদ্ধেক পেঁয়াজ ওর দিনের বেলার খোরাকি। দুপুরে বাড়ি গিয়ে শাপলা বিলে স্নান করে কুচো মাছ পেলে নিয়ে আসে গামছায় ভরে। এক দুটো পড়ে সবার ভাগে। নয়তো নুন আর গরম ভাত। এনামেলের বাটিতে ফ্যান গরম গরম। খেয়ে দেয়ে সাইকেলটা নিয়ে আবার বড়পাড়া। বইয়ের দোকান। ছোটভাইটার ব্লাড ক্যান্সার। সবাই জানে সে বাঁচবে না। কিন্তু যদ্দিন আছে তদ্দিন হু হু করে টাকা বেরোচ্ছে তার পিছনে। বাবার ট্রেনে হকারির টাকা, তার বইয়ের দোকানের মাইনে, মায়ের জমিতে কাজের টাকা সব দিয়েও তার চিকিৎসার কিছুই প্রায় জোগাড় করতে পারে না প্রসাদরা। শুকিয়ে দড়ির মতো হয়ে পড়ে আছে ছোটন। প্রসাদের ভাই। ভালো নামটা আর কেউ ডাকে না, ইশকুলে ভর্তি হয় নি তো। ওই নামটা জন্মের কাগজে কেবল আছে। প্রশান্ত। প্রশান্ত ক্ষেত্রপাল।
মালিনীকে ফুল দেওয়া রোজকার এক আনন্দ হয়েছে প্রসাদের। জল থেকে সুতোর মতো আলোফোটা ভোরে সে প্রথম ফুলটা তোলে মালিনীর জন্য। সে কে, কেমন দেখতে, কোথায় থাকে কিছুই জানে না প্রসাদ। শুধু জানে কুসুমগ্রামের ইশকুলে সে বাংলা পড়ায়। কবিতা পড়ায়। অরবিন্দ স্যারের মতো, রঘুবাবুর মতো। বাংলা পড়ায়। প্রসাদের খুব ইচ্ছে তাকে দ্যাখে। কিন্তু ভাঙা সাইকেলে গিয়ে শাপলার ডাঁটা বিক্রি করার লজ্জা নিয়ে মালিনীকে দেখতে যেতে পারে না প্রসাদ। তাকে সে যতই মালিনী ডাকুক মনে মনে, সে তো মালিনী ম্যাডাম। শাপলার কবিতা পড়ায় সে। আর প্রসাদ কিনা শাপলা বেচতে যায়। কোন সাহসে তার দেখা পেতে যাবে প্রসাদ? মানায় না। সবটা সবাইকে মানায় না।
প্রসাদ কবিতা পড়তে ভালোবাসতো‌। গল্পের চেয়েও বেশি। অরবিন্দ স্যার কী সুন্দর পড়তেন কবিতা। বলতেন, কবিতা লেখা সবার কম্ম নয়, কবিতা বোঝাও সবার নয় কম্ম। প্রসাদ কি সব বোঝে? তবু পড়তে ভালো লাগে কবিতা। মালিনী কবিতা পড়ায়। মালিনী শাড়ি পরে। মালিনীর হাত ছুঁয়ে থাকে শাপলা। কুসুমগ্রামের মালিনী ম্যাডামের পায়ের কাছে এসে বসে থাকে চুপ করে থাকা কিশোরটির সাধের বেলা।
“বইটি আমার খুবই প্রয়োজন।‌ আপনারা এনে দিতে পারবেন শুনে এসেছি। চেষ্টা করবেন।‌ এলে আমাকে জানাবেন। আমার স্কুলের নম্বর দিয়ে যাচ্ছি। একটা ফোন করে দেবেন। বলবেন, মালিনী সেনগুপ্তর বই এসেছে। ওনাকে বলে দিতে।” ” আপনার কোন স্কুল ম্যাডাম?” “কুসুমগ্রাম…” “ও, আপনার তাহলে কোনো চিন্তা নেই। এই ছেলেটি রোজ যায় আপনার স্কুলের পাশেই। ও দিয়ে আসবে।” প্রসাদ থ হয়ে দেখছে তখন। সরস্বতী সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কুসুমগ্রামের মালিনী ম্যাডাম। ওর মালিনী। শাপলা ফুল দিয়ে রোজ যাকে ছোঁয়। মালিনী ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, “বাবু তুমি পারবে তো চিনতে? দিয়ে আসতে পারবে? বলবে মালিনী ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করবো। কেমন? বইটা এলেই দিয়ে এসো। ঠিক আছে?” হাঁ করা মুখটা চোখ নামিয়ে ফেলেছে প্রসাদের। এখন ওর কান্না পাচ্ছে। মাথাটা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে পিছনের তাকের দিকে ঘুরে বইপত্র নাড়তে থাকে প্রসাদ। বড়স্যার বলে “ও ওমনি লাজুক ম্যাডাম। কথা বলতে পারে না কারোর সঙ্গে। ও ঠিক পৌঁছে দেবে। আপনি নিশ্চিত থাকুন চার পাঁচ দিনের মধ্যে বই পেয়ে যাবেন হাতে।”
ভাঙা সাইকেলের কেরিয়ারে বাঁধা শাপলা ডাঁটা। বুকের কোনাকুনি ব্যাগের দড়ি। পাটের সুতোর বস্তা কেটে বানানো ব্যাগে খবরের কাগজে মোড়ানো মালিনীর বই। সুতলি দড়ির মধ্যে ঢোকানো রয়েছে রশিদ‌। একহাজার সাতশো আটান্ন টাকা। মালিনী কত দামী বই পড়ে। মালিনী তার চেয়ে কত গুণ টাকা বেশি রোজগার করে ভাবতেই কেমন চোখ জ্বালা করে প্রসাদের। দামী খদ্দেরকে বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য একবেলা ছুটি পেয়েছে প্রসাদ বইয়ের দোকানে। ফুটফুটেটা ফুল নিয়ে গেছে একটু আগেই। শাপলা বিক্রি হয়ে গেছে ওর। এখন কুসুমগ্রামের ভাঙা হাট ছেড়ে রেলের রাস্তার ডিঙিয়ে মাঠের পাশে ধাবিতে বসে আছে প্রসাদ। কত কী নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে মালিনীর জন্য। অথচ নিয়ে যাওয়া ভালো দেখায় না। শাপলা বেচে তার কাছে নগদ টাকা একশো আশি। বেশি করেই শাপলা এনেছিল আজ। যদি কিছু কিনে দিতে ইচ্ছে করে ওর। ধুর। গরীব প্রেমিকের জ্বালা অনেক। কিনে দেওয়ার ক্ষমতা বা এক্তিয়ার কোনোটাই ওর নেই। আর মালিনী যদি বিষয়টা ভালো চোখে না দ্যাখে বইয়ের দোকানে চাকরিটাও যেতে পারে। প্রসাদ শক্ত হয়। কীসব ভাবছে। ভাইটার কথা ভুলে গেল নাকি। স্কুল খুলতে এখনো বেশ দেরি। চোখের নিচে কাদামাখা শিশিরের মতো ঘাম আর কান্নার ফোঁটা জমেছিল ওর। দু আঙুলে ওই জলটুকু নিয়ে বইমোড়ানো কাগজটায় মাখিয়ে দেয় প্রসাদ। ওর ইচ্ছে যাক, বিষাদ যাক, শরীরের মধু যাক, কাজের জবরদস্তি যাক মালিনীর কাছে। ছুঁয়ে দেখুক মালিনী ওর শরীরের কেমন স্বাদ, ওর জীবনের কেমন জট, ওর রোজকার কেমন এলোমেলো নিয়ে ও বসে আছে একহাজার সাতশো আটান্ন টাকার পাশে।
ইশকুলে ক্লাস শুরুর ঘন্টা বাজলো। প্রসাদ দাঁড়িয়ে আছে গেটে। মালিনী ম্যাডাম আসবেন ক্লাসটা শেষ করেই। কতদিন পর ইশকুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রসাদ। এতদিনে ওর ক্লাস ইলেভেন হওয়ার কথা। সে জানে তার বয়েস আরো বেশি। তার কাম জাগে না, সে প্রেমে ভয় পায়।‌ তার খিদে পায় না, পেলেও ভাইবোনের মুখে তাকিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে। তার ঘুম আসার আগে গরাদগলা চাঁদের আলোয় নেশা লাগে না। গোপন অঙ্গকে গোপনে ঘুমোতে শিখিয়েছে ও।‌ আশপাশে এক বিছানায় সব শোয়। ওর বয়েস হয় নি তো আর কার হয়েছে! ভালোবাসা ওকে অভিমানী করেছে। মালিনীকে দেখা ইস্তক মনখারাপের খাদে পড়ে গেছে ও। স্পষ্ট করে বুঝতে পেরেছে শুধু টাকা কুড়িয়ে বাড়িয়ে থাকার একটা দুর্লভ জন্ম পেয়েছে সে। তাকে পড়াশোনা করতে হবে না।‌তাকে প্রেম করতে হবে না। বিয়ের কথাও বলবে না কেউ খরচ ভাগাভাগি হয়ে যাবে বলে। “এসে পড়েছো? দাঁড়িয়ে আছো না অনেকক্ষণ? এসো ভিতরে এসো।” প্রসাদ মালিনীর দিকে তাকিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ। বললো, “না, ইশকুলের ভিতরে আর যাবো না। আমি ছাত্র নই, মাস্টারও নই।” “কিন্তু তুমি যে তাকে ছাড়া তো স্কুল চলবেই না। আচ্ছা চলো মাঠে চলো। কী খাবে বলো? কুলের আচার? সকাল থেকে খেয়েছো কিছু?” “আমাকে ছাড়া ইশকুল চলবে না কেন?”, প্রসাদ জিজ্ঞেস করলো। “বই। তুমি বই বিক্রি করো। বই নিয়ে এসেছো। তোমাকে ছাড়া স্কুল চলবে কেমন করে শুনি? এই কত টাকা হয়েছে? দাও তো দেখি।” প্রসাদ বইটা এগিয়ে দিল। ওর কান্না গেল ওর ঘাম গেল। বললো, “আমি কিন্তু ফুল বেচি না, তবে সেও আসে ইশকুলে।” মালিনী তখন সারামুখে আনন্দ নিয়ে বই দেখছে। প্রসাদের কথা বোধহয় কানে যায় নি। এক হাজার আটশো টাকা ওর হাতে দিয়ে বললো, “বাকিটা ফেরত দিতে হবে না। ওটা দিয়ে কিছু কিনে খেও।” “আপনি কিন্তু আমাকে একটা বই দিতে পারতেন মালিনী ম্যাডাম। আসছি।” বলে একবিন্দু দেরি না করে সাইকেলে উঠে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে প্রসাদ। পিছনে থাকলো ঘাম, বিষাদজল। ভাঙা সাইকেলে বকশিস সমেত টাকা নিয়ে ফিরছে প্রসাদ। বিষাদবালক। বিষাদবৃদ্ধ।
টাকাটা কাছে রাখতে পারলে ভালো হতো। মালিনীর স্পর্শ। কিন্তু তার কাছে অতখানি টাকা জমানো নেই। বড়স্যারকে দিতে হবে। দেয়ও। বকশিসটা জমা রাখতে বলে। মাইনের সঙ্গেই নেবে। প্রসাদ কাল থেকে সকালে মাছের আড়তে যাবে কাজ করতে। ভোরবেলা মাছ তোলা থেকে সকালের প্রথম প্রহরটুকু প্রচুর মজুর লাগে খেলেডাঙার মাছের আড়তে। বরফ ভাঙার কাজ নিয়েছে আজ দুপুরে কথা বলে এসেছে প্রসাদ। জলেরই তো দুটো প্রাণ। মাছ আর শাপলা। থাক ইচ্ছে। যাক ইচ্ছে। গুলিয়ে উঠুক খালি পেটের সকাল। মাছের আড়তে মালিনীর গন্ধ নাক থেকে মুছে যাবে ধীরে ধীরে ঠিক।

লেখক-মঞ্জিমা
শান্তিনিকেতন, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।