সিলেট ০৯:০৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫
News Title :
‎সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় গরু-মহিষের চোরাচালান আটক: বিজিবি’র সাফল্য ‎সখীপুরে মুসলিম জুয়েলার্সকে ১ লাখ টাকা জরিমানা ‎ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি ও গাজায় গণহত্যা বন্ধের দাবিতে হবিগঞ্জে আইনজীবীদের মানববন্ধন ‎টাঙ্গাইল সদরে চাড়াবাড়ি এস ডি এস ব্রীজের পশ্চিম অংশ ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন মৃতের স্ত্রী হত্যা মামলা দিয়ে সাংবাদিক পরিবারকে হয়রানি, তদন্ত প্রতিবেদনের উপর তিনবার নারাজি ॥ ‎চট্টগ্রামের উদয়ন এক্সপ্রেস মোগলাবাজারে লাইনচ্যুত: রেলপথে ব্যাপক শিডিউল বিপর্যয়‎ ‎গোয়াইনঘাটে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বীজ, সার ও কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ ‎তামাবিল স্থলবন্দর পরিদর্শন করলেন কাস্টমস কমিশনার‎ ‎সিলেটের জৈন্তাপুরে আসামপাড়া আদর্শ বালু পাথর ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচন: মানিক আহমেদ সভাপতি, শাহজাহান মিয়া সাধারণ সম্পাদক ‎ক্লাসে টিকটক ভিডিও: নবীগঞ্জে তিন শিক্ষার্থী সাময়িক বহিষ্কার

মদিনার পথে এক আবেগঘন সফর, ওমরাহ পালনের অভিজ্ঞতা, গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির জার্নি।

আবদুল হক মামুন

সোনার মদিনা বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) রওজামোবারক।

পবিত্র ওমরাহ, মদিনার পথে এক আবেগঘন সফর
সদ্য সম্পন্ন হওয়া ওমরাহ পালনের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের ১৩ জনের গ্রুপটির সফর ছিল এক গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির জার্নি।
আমাদের দলনেতা গোলাম মোস্তফা লিটন স্যারের নেতৃত্বে ১১ সেপ্টেম্বরে ভিসা ও টিকিট কনফার্ম করে আমরা প্রস্তুত হই আল্লাহর ঘরের পথে যাত্রা করার জন্য।

যাত্রা ও বিমানবন্দর বিড়ম্বনা

সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সকাল ১১:৪০ মিনিটে আমাদের ফ্লাইট থাকলেও আমরা ৯টার মধ্যেই বিমানবন্দরে পৌঁছে যাই। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের বাংলাদেশ বিমানের বিজি ২৩৬ নং ফ্লাইটটি প্রথমে এক ঘণ্টা দেরিতে রওনা করে। ট্রাভেলস এজেন্সি প্রথমে সিলেট-ঢাকা-মদিনা রুটের কথা বললেও বাস্তবে রুটে পরিবর্তন আসে—সিলেট-ঢাকা-চট্টগ্রাম-মদিনা। এই অতিরিক্ত বিরতির কারণে সেখানেও আমাদের আরও এক ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়।


অবশেষে চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি মদিনার উদ্দেশ্যে বিমান উড়াল দেয়। প্রায় ৬ ঘণ্টার যাত্রা শেষে মদিনা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে আমাদের বিমান অবতরণ করে।

মদিনা এয়ারপোর্ট ও মুয়াল্লিম সমস্যা

মদিনায় নেমে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম দ্রুত শেষ হলেও শুরু হয় প্রথম অসঙ্গতি। ট্রাভেলস এজেন্সি থেকে কথা ছিল মুয়াল্লিম আমাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করবেন, কিন্তু তার দেখা মেলেনি। এই সময় অল্প সময়ের জন্য আমরা কিছুটা হতাশ হই। তবে আল্লাহর রহমতে, একজন লোক (সম্ভবত ইমিগ্রেশনের সাথে জড়িত) আমাদের ভিসা দেখে পথ দেখিয়ে দেন এবং কিছুক্ষণ পরই হোটেলের বাস খুঁজে দেন। মুয়াল্লিমের নাম্বার নিয়ে বাস ড্রাইভারের সাহায্যে অবশেষে আমরা হোটেলে পৌঁছাই। পরে মুয়াল্লিম মনির ভূঁইয়া এসে আমাদের রুমে নিয়ে যান।

মসজিদে নববীতে আমরা (আংশিক কয়েকজন)।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, আমাদের ট্রাভেলস এজেন্সির দেওয়া কথা ও কাজের মধ্যে কোনো মিল ছিল না!

হোটেলের মান ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে হতাশা!

সিলেটের স্বনামধন্য একটি এজেন্সি হওয়া সত্ত্বেও, এজেন্সি আমাদের ৩ স্টার মানের হোটেলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, (যদি-ও তাদের নাম প্রকাশ করলাম না আপাতত) কিন্তু বাস্তবে তা ছিল খুবই সাধারণ মানের। পাঁচজনের জন্য বরাদ্দ রুমটি ছিল ছোট ছোট খাট দিয়ে ঠাসা, যা খুবই আঁটোসাঁটো।
রুম সার্ভিস তো দূরের কথা, সামান্য সুযোগ-সুবিধাটুকুও আমরা পাইনি।
বিশেষ করে, আমাদের দেশের ভালো মানের হোটেলের মতো টুথব্রাশ, সাবান, শ্যাম্পু, তোয়ালে ইত্যাদি কোনো কিছুই দেওয়া হয়নি।
বারবার বলার পরও সাবান বা টিস্যু না পেয়ে নিজেদের কিনে নিতে হয়।
এজেন্সি হাজিদের সাথে চরম প্রতারণা করেছে—দীর্ঘ অপেক্ষার পর একদিন হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদের আল আমিনের সুপার বিস্কুটের মতো দুইটি সাবান দেয়, যা দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম!
ওমরাহ যাত্রায় যারা যাবেন, তাদের জন্য একটি পরামর্শ: সবকিছু জেনেশুনে ও বুঝে যাত্রা করা উচিত।

সোনার মদিনা: প্রশান্তির ঠিকানা

রওজামোবারক ভেতর

হোটেলে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে স্থানীয় বাঙালি হোটেলে খাবার খেয়ে মুয়াল্লিমের সাথে আমরা রওনা হলাম মসজিদে নববীর দিকে। সেখানে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর রওজা মোবারকে সালাম জানিয়ে নফল ও কাজা নামাজ আদায় করে হোটেলে ফিরি।
শারীরিক ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও আমরা ঘুমাতে যাইনি। তাহাজ্জুদ ও ফজর নামাজ মিস হবে এই ভেবে হালকা বিশ্রাম নিয়ে আবার ছুটে যাই মসজিদে নববীতে।
রওজা মোবারকে সালাম ও আবেগময় মুহূর্ত
সোনার মদিনা সত্যিই এক শান্তির জায়গা। মক্কার চেয়ে মদিনায় শান্তি ও শৃঙ্খলা অনেক বেশি অনুভূত হয়। আমরা তাহাজ্জুদ ও ফজর নামাজ আদায় করে রওজা মোবারকে সালাম জানাতে যাই।
লক্ষাধিক মানুষের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে যখন আমরা রওজা মোবারকের কাছে পৌঁছাই, তখন মনে চরম উত্তেজনা বিরাজ করে। জন্মের পর থেকে যে সোনার মদিনার কথা শুনে এসেছি, আজ স্ব-শরীরে রাসুল পাকের রওজাতে সালাম জানাতে পেরে মন পরম প্রশান্তিতে ভরে গেল।

  • লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি,মসজিদে নববীতে দৈনিক প্রতি ওয়াক্তে কী পরিমাণ মানুষ নামাজ আদায় করেন, তা নির্ণয় করা সত্যিই কঠিন।
  • জানাজার নামাজ: একটি বিরল অভিজ্ঞতা হলো, আমরা প্রতি ওয়াক্তে জামাতের পর জানাজার নামাজ আদায় করেছি।

মদিনার আবহাওয়া ও পরিচ্ছন্নতা

মদিনার আবহাওয়া দিনের বেলায় ৪৫/৪৭ ডিগ্রি এবং রাতে ৩৫/৩৮ ডিগ্রি পর্যন্ত থাকে। বাতাস শরীরে লাগলে যেন আগুনের আঁচ অনুভূত হয়, তবে আশ্চর্যজনকভাবে শরীর ঘামে না বা ক্লান্তি লাগে না।
রাস্তাঘাট খুবই পরিচ্ছন্ন। পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের (যাদের অধিকাংশই বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বাসিন্দা) নিরলস পরিশ্রমে পরিবেশ সবসময় ধুলোবালি মুক্ত থাকে।


ওমরাহ যাত্রীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু টিপস
আবশ্যিক সামগ্রী ও কেনাকাটা

  • সুরক্ষার জন্য: মদিনার রোদে পা ফেটে যায়, তাই অবশ্যই মোজা সাথে নেবেন। পাশাপাশি, ত্বক ভালো রাখতে অলিভ অয়েল, সানস্ক্রিন লোশন বা ভ্যাসলিন আবশ্যক। সম্ভব হলে কেডস ও ফুলহাতা জামা নিন।
  • পোশাক: শার্ট-প্যান্টের পরিবর্তে ফুলহাতা জামা নেওয়া ভালো।
  • খেজুর: মক্কা থেকে খেজুর কেনার চিন্তা বাদ দিন। মদিনা থেকে খেজুর কিনবেন। এখানে হরেক রকমের উন্নত জাতের বিখ্যাত খেজুর পাওয়া যায়। কেনার সময় দরদাম করবেন এবং অবশ্যই দোকানদারকে নতুন বছরের খেজুর দিতে বলবেন (পুরনো খেজুরে পোকা থাকতে পারে)।
  • বিমান মালপত্র: মোট ৫০ কেজি মালপত্র (হাতে ৭ কেজি) বহন করতে পারবেন। এছাড়াও ৫ লিটার জমজমের পানি এয়ারপোর্ট থেকে কিনলে এটি ৫০ কেজির ওজনের বাইরে ধরা হয়। ২৬ কেজির কাটুন না করে ২৫ কেজির প্যাকেজিং করবেন।
  • পানি: মক্কা-মদিনায় কোথাও পানি কিনে খাবার প্রয়োজন নেই। মসজিদে নববীতে এবং এর বাইরে সব জায়গাতেই জমজমের পানির ব্যবস্থা আছে। ছোট্ট বোতলে পানি ভরে আনা যেতে পারে।
    খাবার ব্যবস্থাপনা

ওমরাহ প্যাকেজে খাবার না নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এজেন্সি তাদের মতো খাবার পরিবেশন করে যা নির্দিষ্ট সময়ে না খেলে ঠান্ডা বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

  • বাঙালি খাবার: মক্কা-মদিনায় অনেক বাংলাদেশি আছেন, যারা বাসায় রান্না করে আপনার হোটেলে খাবার পৌঁছে দেবেন। খাবারের মানও ভালো থাকে। আপনি কী খেতে চান, সেই অনুযায়ী বলে দিলে তারা দিয়ে দেবে।
  • রেস্তোরাঁ: প্রচুর বাঙালি খাবারের দোকান পাবেন, যেখানে নিজের ইচ্ছেমতো খেতে পারবেন।
  • সাশ্রয়ী উপায়: কয়েকজন মিলে একসাথে খাবার কিনে খেলে সাশ্রয়ী হবে। যেমন: একটি রুটির দাম ১ রিয়াল, সবজি/ডাল ৩-৪ রিয়াল (১ রিয়াল প্রায় ৩৩ টাকা)। ৮ জনের খাবার কিনলে তা ১২ জন অনায়াসে খেতে পারে।

মদিনার ইবাদত ও দর্শনীয় স্থান

মসজিদে নববীতে মুসল্লীদের প্রবেসের দৃশ্য।

মসজিদে নববীতে রুটিন চেষ্টা করবেন অহেতুক বাইরে সময় নষ্ট না করে মসজিদে নববীতে ইবাদত-বন্দেগি করে সময় পার করতে।
প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা এবং প্রতি ওয়াক্তে রওজা মোবারকে সালাম জানানো আমাদের রুটিন হয়ে গিয়েছিল।

  • রওজা মোবারক স্পর্শ: রওজা মোবারকে সবসময় ভিড় থাকে। তবে যোহরের নামাজের পর লোকজনের ভিড় কিছুটা কমে। এই সময়টিতে রওজা মোবারকের খুব কাছ দিয়ে যাওয়া যায় এবং ভাগ্য ভালো থাকলে তা স্পর্শ করার সুযোগও হতে পারে।
    আমার সুভাগ্য আমি দুইবার হাত দিয়ে চুয়েছিলাম। সবাই চেষ্টা করবেন দুপুরে এই সুযোগটি নিতে।
  • ওজু: সবসময় ওজু অবস্থায় থাকার চেষ্টা করবেন। মসজিদে নববী ও মক্কাতে উন্নতমানের টয়লেট ও ওজুর ব্যবস্থা আছে।
  • ক্লান্তি দূর করা: ফরজ নামাজের পর অবসর সময়ে নফল বা কাজা নামাজ আদায় করুন। ক্লান্ত লাগলে মসজিদে নববীর ভেতরে কিছু সময় ঘুমিয়েও নিতে পারবেন।

জেয়ারা (দর্শনীয় স্থান)

হযরত আবু বক্কর ছিদ্দিক (রঃ) মসজিদ

ওমরাহ প্যাকেজে সাধারণত একদিন জেয়ারা থাকে, যেখানে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে গিয়ে নফল নামাজ আদায় করা যায়। এই জেয়ারা সকালে শুরু করলে দুপুরের আগেই শেষ করা যায়। শুধু জিনের পাহাড় একটু দূরে, সেখানে আলাদা গাড়িতে যেতে হয়।

কুবা মসজিদ জিয়ারত (অবশ্যই করণীয়)

  • ফজরের পর: মসজিদে নববীতে ফজর নামাজ আদায়ের পর হেঁটে হেঁটে কুবা মসজিদে যাওয়া উচিত। নবীজী (সাঃ) ফজরের পর সাহাবিদের নিয়ে সেখানে নফল নামাজ আদায় করতেন।
  • সওয়াব: কুবা মসজিদে ২ রাকাত নফল নামাজ আদায় করলে একটি ওমরাহ হজের সওয়াব পাওয়া যায়।
  • গুরুত্ব: হেরেম শরীফ, মসজিদে নববী, বাইতুল মুকাদ্দসের পর কুবা মসজিদ হলো ৪ নম্বর গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
    নবীজী (সাঃ) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর মদিনাবাসী কুবা মসজিদেই তাকে স্বাগত জানান, সেই থেকে এর গুরুত্ব বাড়ে।
  • যাতায়াত: হাঁটতে অসুবিধা হলে মসজিদে নববীর বাইরে থেকে ছোট গাড়িতে (জনপ্রতি ১০ রিয়াল) অথবা কার বা হাইএসে (২ রিয়াল) যাওয়া যায়।

জান্নাতুল বাকী

জান্নাতুল বাকী, এখানে সাহাবীগণ চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।

ফজরের পর ও আছরের পর মসজিদে নববীর পাশে জান্নাতুল বাকী জিয়ারত করা যায়। এটি সাহাবীদের কবরস্থান, যেখানে এখনো মদিনার ধনী শ্রেণীর লোকদের কবর দেওয়া হয়।

মদিনা সত্যিই শান্তি, শৃঙ্খলা ও প্রশান্তির স্থান। আল্লাহ পাক যেন সবার ভাগ্যে একবার হলেও মক্কা ও মদিনায় যাওয়ার সুযোগ করে দেন।

চলবে… পরবর্তী পর্বে পবিত্র মক্কা শরীফ নিয়ে লিখব।

ট্যাগস :
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

‎সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় গরু-মহিষের চোরাচালান আটক: বিজিবি’র সাফল্য

মদিনার পথে এক আবেগঘন সফর, ওমরাহ পালনের অভিজ্ঞতা, গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির জার্নি।

সময় ১১:০০:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫

আবদুল হক মামুন

সোনার মদিনা বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) রওজামোবারক।

পবিত্র ওমরাহ, মদিনার পথে এক আবেগঘন সফর
সদ্য সম্পন্ন হওয়া ওমরাহ পালনের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের ১৩ জনের গ্রুপটির সফর ছিল এক গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির জার্নি।
আমাদের দলনেতা গোলাম মোস্তফা লিটন স্যারের নেতৃত্বে ১১ সেপ্টেম্বরে ভিসা ও টিকিট কনফার্ম করে আমরা প্রস্তুত হই আল্লাহর ঘরের পথে যাত্রা করার জন্য।

যাত্রা ও বিমানবন্দর বিড়ম্বনা

সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সকাল ১১:৪০ মিনিটে আমাদের ফ্লাইট থাকলেও আমরা ৯টার মধ্যেই বিমানবন্দরে পৌঁছে যাই। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের বাংলাদেশ বিমানের বিজি ২৩৬ নং ফ্লাইটটি প্রথমে এক ঘণ্টা দেরিতে রওনা করে। ট্রাভেলস এজেন্সি প্রথমে সিলেট-ঢাকা-মদিনা রুটের কথা বললেও বাস্তবে রুটে পরিবর্তন আসে—সিলেট-ঢাকা-চট্টগ্রাম-মদিনা। এই অতিরিক্ত বিরতির কারণে সেখানেও আমাদের আরও এক ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়।


অবশেষে চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি মদিনার উদ্দেশ্যে বিমান উড়াল দেয়। প্রায় ৬ ঘণ্টার যাত্রা শেষে মদিনা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে আমাদের বিমান অবতরণ করে।

মদিনা এয়ারপোর্ট ও মুয়াল্লিম সমস্যা

মদিনায় নেমে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম দ্রুত শেষ হলেও শুরু হয় প্রথম অসঙ্গতি। ট্রাভেলস এজেন্সি থেকে কথা ছিল মুয়াল্লিম আমাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করবেন, কিন্তু তার দেখা মেলেনি। এই সময় অল্প সময়ের জন্য আমরা কিছুটা হতাশ হই। তবে আল্লাহর রহমতে, একজন লোক (সম্ভবত ইমিগ্রেশনের সাথে জড়িত) আমাদের ভিসা দেখে পথ দেখিয়ে দেন এবং কিছুক্ষণ পরই হোটেলের বাস খুঁজে দেন। মুয়াল্লিমের নাম্বার নিয়ে বাস ড্রাইভারের সাহায্যে অবশেষে আমরা হোটেলে পৌঁছাই। পরে মুয়াল্লিম মনির ভূঁইয়া এসে আমাদের রুমে নিয়ে যান।

মসজিদে নববীতে আমরা (আংশিক কয়েকজন)।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, আমাদের ট্রাভেলস এজেন্সির দেওয়া কথা ও কাজের মধ্যে কোনো মিল ছিল না!

হোটেলের মান ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে হতাশা!

সিলেটের স্বনামধন্য একটি এজেন্সি হওয়া সত্ত্বেও, এজেন্সি আমাদের ৩ স্টার মানের হোটেলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, (যদি-ও তাদের নাম প্রকাশ করলাম না আপাতত) কিন্তু বাস্তবে তা ছিল খুবই সাধারণ মানের। পাঁচজনের জন্য বরাদ্দ রুমটি ছিল ছোট ছোট খাট দিয়ে ঠাসা, যা খুবই আঁটোসাঁটো।
রুম সার্ভিস তো দূরের কথা, সামান্য সুযোগ-সুবিধাটুকুও আমরা পাইনি।
বিশেষ করে, আমাদের দেশের ভালো মানের হোটেলের মতো টুথব্রাশ, সাবান, শ্যাম্পু, তোয়ালে ইত্যাদি কোনো কিছুই দেওয়া হয়নি।
বারবার বলার পরও সাবান বা টিস্যু না পেয়ে নিজেদের কিনে নিতে হয়।
এজেন্সি হাজিদের সাথে চরম প্রতারণা করেছে—দীর্ঘ অপেক্ষার পর একদিন হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদের আল আমিনের সুপার বিস্কুটের মতো দুইটি সাবান দেয়, যা দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম!
ওমরাহ যাত্রায় যারা যাবেন, তাদের জন্য একটি পরামর্শ: সবকিছু জেনেশুনে ও বুঝে যাত্রা করা উচিত।

সোনার মদিনা: প্রশান্তির ঠিকানা

রওজামোবারক ভেতর

হোটেলে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে স্থানীয় বাঙালি হোটেলে খাবার খেয়ে মুয়াল্লিমের সাথে আমরা রওনা হলাম মসজিদে নববীর দিকে। সেখানে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর রওজা মোবারকে সালাম জানিয়ে নফল ও কাজা নামাজ আদায় করে হোটেলে ফিরি।
শারীরিক ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও আমরা ঘুমাতে যাইনি। তাহাজ্জুদ ও ফজর নামাজ মিস হবে এই ভেবে হালকা বিশ্রাম নিয়ে আবার ছুটে যাই মসজিদে নববীতে।
রওজা মোবারকে সালাম ও আবেগময় মুহূর্ত
সোনার মদিনা সত্যিই এক শান্তির জায়গা। মক্কার চেয়ে মদিনায় শান্তি ও শৃঙ্খলা অনেক বেশি অনুভূত হয়। আমরা তাহাজ্জুদ ও ফজর নামাজ আদায় করে রওজা মোবারকে সালাম জানাতে যাই।
লক্ষাধিক মানুষের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে যখন আমরা রওজা মোবারকের কাছে পৌঁছাই, তখন মনে চরম উত্তেজনা বিরাজ করে। জন্মের পর থেকে যে সোনার মদিনার কথা শুনে এসেছি, আজ স্ব-শরীরে রাসুল পাকের রওজাতে সালাম জানাতে পেরে মন পরম প্রশান্তিতে ভরে গেল।

  • লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি,মসজিদে নববীতে দৈনিক প্রতি ওয়াক্তে কী পরিমাণ মানুষ নামাজ আদায় করেন, তা নির্ণয় করা সত্যিই কঠিন।
  • জানাজার নামাজ: একটি বিরল অভিজ্ঞতা হলো, আমরা প্রতি ওয়াক্তে জামাতের পর জানাজার নামাজ আদায় করেছি।

মদিনার আবহাওয়া ও পরিচ্ছন্নতা

মদিনার আবহাওয়া দিনের বেলায় ৪৫/৪৭ ডিগ্রি এবং রাতে ৩৫/৩৮ ডিগ্রি পর্যন্ত থাকে। বাতাস শরীরে লাগলে যেন আগুনের আঁচ অনুভূত হয়, তবে আশ্চর্যজনকভাবে শরীর ঘামে না বা ক্লান্তি লাগে না।
রাস্তাঘাট খুবই পরিচ্ছন্ন। পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের (যাদের অধিকাংশই বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বাসিন্দা) নিরলস পরিশ্রমে পরিবেশ সবসময় ধুলোবালি মুক্ত থাকে।


ওমরাহ যাত্রীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু টিপস
আবশ্যিক সামগ্রী ও কেনাকাটা

  • সুরক্ষার জন্য: মদিনার রোদে পা ফেটে যায়, তাই অবশ্যই মোজা সাথে নেবেন। পাশাপাশি, ত্বক ভালো রাখতে অলিভ অয়েল, সানস্ক্রিন লোশন বা ভ্যাসলিন আবশ্যক। সম্ভব হলে কেডস ও ফুলহাতা জামা নিন।
  • পোশাক: শার্ট-প্যান্টের পরিবর্তে ফুলহাতা জামা নেওয়া ভালো।
  • খেজুর: মক্কা থেকে খেজুর কেনার চিন্তা বাদ দিন। মদিনা থেকে খেজুর কিনবেন। এখানে হরেক রকমের উন্নত জাতের বিখ্যাত খেজুর পাওয়া যায়। কেনার সময় দরদাম করবেন এবং অবশ্যই দোকানদারকে নতুন বছরের খেজুর দিতে বলবেন (পুরনো খেজুরে পোকা থাকতে পারে)।
  • বিমান মালপত্র: মোট ৫০ কেজি মালপত্র (হাতে ৭ কেজি) বহন করতে পারবেন। এছাড়াও ৫ লিটার জমজমের পানি এয়ারপোর্ট থেকে কিনলে এটি ৫০ কেজির ওজনের বাইরে ধরা হয়। ২৬ কেজির কাটুন না করে ২৫ কেজির প্যাকেজিং করবেন।
  • পানি: মক্কা-মদিনায় কোথাও পানি কিনে খাবার প্রয়োজন নেই। মসজিদে নববীতে এবং এর বাইরে সব জায়গাতেই জমজমের পানির ব্যবস্থা আছে। ছোট্ট বোতলে পানি ভরে আনা যেতে পারে।
    খাবার ব্যবস্থাপনা

ওমরাহ প্যাকেজে খাবার না নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এজেন্সি তাদের মতো খাবার পরিবেশন করে যা নির্দিষ্ট সময়ে না খেলে ঠান্ডা বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

  • বাঙালি খাবার: মক্কা-মদিনায় অনেক বাংলাদেশি আছেন, যারা বাসায় রান্না করে আপনার হোটেলে খাবার পৌঁছে দেবেন। খাবারের মানও ভালো থাকে। আপনি কী খেতে চান, সেই অনুযায়ী বলে দিলে তারা দিয়ে দেবে।
  • রেস্তোরাঁ: প্রচুর বাঙালি খাবারের দোকান পাবেন, যেখানে নিজের ইচ্ছেমতো খেতে পারবেন।
  • সাশ্রয়ী উপায়: কয়েকজন মিলে একসাথে খাবার কিনে খেলে সাশ্রয়ী হবে। যেমন: একটি রুটির দাম ১ রিয়াল, সবজি/ডাল ৩-৪ রিয়াল (১ রিয়াল প্রায় ৩৩ টাকা)। ৮ জনের খাবার কিনলে তা ১২ জন অনায়াসে খেতে পারে।

মদিনার ইবাদত ও দর্শনীয় স্থান

মসজিদে নববীতে মুসল্লীদের প্রবেসের দৃশ্য।

মসজিদে নববীতে রুটিন চেষ্টা করবেন অহেতুক বাইরে সময় নষ্ট না করে মসজিদে নববীতে ইবাদত-বন্দেগি করে সময় পার করতে।
প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা এবং প্রতি ওয়াক্তে রওজা মোবারকে সালাম জানানো আমাদের রুটিন হয়ে গিয়েছিল।

  • রওজা মোবারক স্পর্শ: রওজা মোবারকে সবসময় ভিড় থাকে। তবে যোহরের নামাজের পর লোকজনের ভিড় কিছুটা কমে। এই সময়টিতে রওজা মোবারকের খুব কাছ দিয়ে যাওয়া যায় এবং ভাগ্য ভালো থাকলে তা স্পর্শ করার সুযোগও হতে পারে।
    আমার সুভাগ্য আমি দুইবার হাত দিয়ে চুয়েছিলাম। সবাই চেষ্টা করবেন দুপুরে এই সুযোগটি নিতে।
  • ওজু: সবসময় ওজু অবস্থায় থাকার চেষ্টা করবেন। মসজিদে নববী ও মক্কাতে উন্নতমানের টয়লেট ও ওজুর ব্যবস্থা আছে।
  • ক্লান্তি দূর করা: ফরজ নামাজের পর অবসর সময়ে নফল বা কাজা নামাজ আদায় করুন। ক্লান্ত লাগলে মসজিদে নববীর ভেতরে কিছু সময় ঘুমিয়েও নিতে পারবেন।

জেয়ারা (দর্শনীয় স্থান)

হযরত আবু বক্কর ছিদ্দিক (রঃ) মসজিদ

ওমরাহ প্যাকেজে সাধারণত একদিন জেয়ারা থাকে, যেখানে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে গিয়ে নফল নামাজ আদায় করা যায়। এই জেয়ারা সকালে শুরু করলে দুপুরের আগেই শেষ করা যায়। শুধু জিনের পাহাড় একটু দূরে, সেখানে আলাদা গাড়িতে যেতে হয়।

কুবা মসজিদ জিয়ারত (অবশ্যই করণীয়)

  • ফজরের পর: মসজিদে নববীতে ফজর নামাজ আদায়ের পর হেঁটে হেঁটে কুবা মসজিদে যাওয়া উচিত। নবীজী (সাঃ) ফজরের পর সাহাবিদের নিয়ে সেখানে নফল নামাজ আদায় করতেন।
  • সওয়াব: কুবা মসজিদে ২ রাকাত নফল নামাজ আদায় করলে একটি ওমরাহ হজের সওয়াব পাওয়া যায়।
  • গুরুত্ব: হেরেম শরীফ, মসজিদে নববী, বাইতুল মুকাদ্দসের পর কুবা মসজিদ হলো ৪ নম্বর গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
    নবীজী (সাঃ) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর মদিনাবাসী কুবা মসজিদেই তাকে স্বাগত জানান, সেই থেকে এর গুরুত্ব বাড়ে।
  • যাতায়াত: হাঁটতে অসুবিধা হলে মসজিদে নববীর বাইরে থেকে ছোট গাড়িতে (জনপ্রতি ১০ রিয়াল) অথবা কার বা হাইএসে (২ রিয়াল) যাওয়া যায়।

জান্নাতুল বাকী

জান্নাতুল বাকী, এখানে সাহাবীগণ চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।

ফজরের পর ও আছরের পর মসজিদে নববীর পাশে জান্নাতুল বাকী জিয়ারত করা যায়। এটি সাহাবীদের কবরস্থান, যেখানে এখনো মদিনার ধনী শ্রেণীর লোকদের কবর দেওয়া হয়।

মদিনা সত্যিই শান্তি, শৃঙ্খলা ও প্রশান্তির স্থান। আল্লাহ পাক যেন সবার ভাগ্যে একবার হলেও মক্কা ও মদিনায় যাওয়ার সুযোগ করে দেন।

চলবে… পরবর্তী পর্বে পবিত্র মক্কা শরীফ নিয়ে লিখব।