সিলেট ০৬:৫১ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫
News Title :
‎সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় গরু-মহিষের চোরাচালান আটক: বিজিবি’র সাফল্য ‎সখীপুরে মুসলিম জুয়েলার্সকে ১ লাখ টাকা জরিমানা ‎ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি ও গাজায় গণহত্যা বন্ধের দাবিতে হবিগঞ্জে আইনজীবীদের মানববন্ধন ‎টাঙ্গাইল সদরে চাড়াবাড়ি এস ডি এস ব্রীজের পশ্চিম অংশ ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন মৃতের স্ত্রী হত্যা মামলা দিয়ে সাংবাদিক পরিবারকে হয়রানি, তদন্ত প্রতিবেদনের উপর তিনবার নারাজি ॥ ‎চট্টগ্রামের উদয়ন এক্সপ্রেস মোগলাবাজারে লাইনচ্যুত: রেলপথে ব্যাপক শিডিউল বিপর্যয়‎ ‎গোয়াইনঘাটে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বীজ, সার ও কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ ‎তামাবিল স্থলবন্দর পরিদর্শন করলেন কাস্টমস কমিশনার‎ ‎সিলেটের জৈন্তাপুরে আসামপাড়া আদর্শ বালু পাথর ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচন: মানিক আহমেদ সভাপতি, শাহজাহান মিয়া সাধারণ সম্পাদক ‎ক্লাসে টিকটক ভিডিও: নবীগঞ্জে তিন শিক্ষার্থী সাময়িক বহিষ্কার

বানিয়াচং পর্যটনের এক অপার সম্ভাবনাময় সুবর্ণভূমি।

লক্ষীবাউর জলাবন, বর্ষায় দারুণ মনোমুগ্ধকর।

পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় সুবর্ণভূমি হলো হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রাম, যা এককালে পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। যদি এই গ্রামকে একটি পরিকল্পিত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তবে সরকার বছরে কোটি টাকার উপরে রাজস্ব আয় করতে পারবে। 

বানিয়াচংয়ের নৈসর্গিক রূপ, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং সমৃদ্ধ লোকগাথা এটিকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য এক অনন্য আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলতে পারে। 

ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও লোকসংস্কৃতি

এক সময়ের এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম ৩২.৪৩ বর্গ মাইল আয়তন ও দুই লক্ষ লোক সংখ্যার ভিত্তিতে পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে অনানুষ্ঠনিকভাবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। 

৪টি ইউনিয়নে বিভক্ত এ গ্রাম। মধ্যভাগে গড়ে উঠেছে উপজেলা শহর। চারপাশে গ্রামীণ সৌম্য পরিবেশ ও বর্ধিষ্ণু শহরের কর্মচাঞ্চলতায় অপূর্ব অনূভূতির সংমিশ্রণ ঘটায়। গড়ের খালের বেষ্টনী দিয়ে রেখেছে গ্রামটি কে।

পাখির চোখে কমলাবতীর দিঘি

কালের স্বাক্ষী রাজ-রাণী, শাহজাদা-শাহাজাদী ও জমিদার ও প্রজাদের কাহিনী নিয়ে আলাল-দুলাল (দেওয়ানা মদিনা) ছুরত জামাল ও অধূয়া সুন্দরী আমেনা সুন্দরী ও ফিরোজ খাঁ দেওয়ান, রাণী ভবাণী, রাজ কুমারী ও গায়েন, চৌধুরীদের লড়াই ও সিপাহী আফজাল খান ও জমিদার কন্যা আরজু বানুর উপখ্যান ও লোকগাঁথা পূর্ব বাংলায় লোক সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে দখল করে আছে। 

প্রাচীন নিদর্শন ও পুরাকীর্তি রাজবাড়ীর

ধ্বংসাবশেষ, ৫শ থেকে ২শ বছরের পূর্বের মুঘল স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত তিন গম্বুজ বিশিষ্ট ১১টি মসজিদসহ ১২০টি মসজিদ রয়েছে। 

৪শ বছরের প্রাচীন জয়কালী মন্দির ও শ্যাম বাউলের আখড়া এবং গ্রামের অদূরবর্তীতেই রয়েছে বিথঙ্গল বৈষ্ণব আখড়া ও সোয়াম ও রীড ফরেস্ট লক্ষী বাঁওড় (জলজবন) রয়েছে। 

প্রাকৃতিক শোভায় সুশোভিত ছয়টি দীঘি মুগ্ধ করে দেশী বিদেশী পর্যটকদের। 

বিশেষ করে বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম সাগর দীঘিকে ঘিরে রয়েছে পর্যটনের হাতছানি। 

ঘন বন-বনানী ও ঢাকা নগরীর আদলে আঁকাবাঁকা ও অসংখ্য সরু রাস্তা ধরে (দালান-অট্টালিকার স্থলে ) সারি সারি বৃক্ষরাজির সুশীতল ছায়া । 

দীঘি এবং পাঁচ শতাধিক পুকুর ও বিল-ঝিলের পাড়ে নান্দনিক ও শৈল্পিকভাবে গড়ে ওঠা সবুজে ঘেরা জন বসতির পাড়া ও মহল্লার অবস্থান বিমোহিত করে। 

পল্লী কবি জসিম উদ্দিন ঐতিহাসিক বানিয়াচংয়ে পরিদর্শনে এলে নয়নাভিরাম সাগর দীঘির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে এর পাড়ে বসেই ‘রাণী কমলাবতীর দীঘি’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। 

এ কবিতাটি তার সূচয়ণী কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। 

ঐতিহাসিকদের মতে, পঞ্চাশ খ্রীষ্টাব্দে হাওর দ্বীপে বানিয়াচং গ্রামের গোড়া পত্তন হয়। ধারনা করা হয় গ্রামের অভ্যন্তরে ও ওপাশ দিয়ে পুরাতন কুশিয়ারা ও এর শাখা সুটকী ও কেছুরিয়া নদী প্রবাহিত ছিল। 

ভূমিকম্পের বিবর্তনে নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তন ও মরা অংশ পলল ভূমিতে ভরাট হয়ে যাওয়ায়  প্রজাদের মধ্যে পানীয় জলের সংকট দেখা দেয়।

রাজন্যবর্গ ও পরবর্তীতে জমিদারগণ অসংখ্য পুকুর খননসহ সাগরদীঘি, দেওয়ানদীঘি, ঠাকুরাণীর দীঘি, মজলিশ খাঁর দীঘি, জামাল খাঁর দীঘি ও দেবাল দীঘি খনন করেন। এসব দীঘির অধিকাংশ দখল হয়ে ১৯৫৬ সালে এসএ রেকর্ডে চারপাড় বাসীর অনেকের মালিকানায় চলে যাওয়ায় আয়তনে ছোট হয়ে দীঘিগুলো রূপ বৈচিত্র হারিয়েছে এবং হারাচ্ছে। 

সাগর দিঘি

বিশেষ করে সাগরদীঘি ১২০ একরের মধ্যে ৬৬ একর সরকারের খাস খতিয়ানে রেকর্ড ভূক্ত হয়েছে। বিভিন্ন গ্রন্থে জানা যায়, দ্বাদশ শতাব্দীর কোন এক সময়ে রাজা পদ্মনাভ (মনাই রাজা) গ্রামের মধ্যভাগে ১২০ একর জায়গা জুড়ে এক বিশাল দীঘি খনন করেন। 

দীঘিতে পানি না ওঠায় স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে রাজা পদ্মনাভের স্ত্রী রাণী কমলাবতী আত্ম বিসর্জন দিলে দীঘিতে পানি ভরে ওঠে (এই নিয়ে লোকগাথা অনেক কল্পকাহিনী আছে)। তাই এ দীঘিকে ‘রাণী কমলাবতীর দীঘি’ সাগর দিঘি বলা হয়ে থাকে।

দীর্ঘদিনে অযত্নে অবহেলায় দীঘিটি ভরাট হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮৭ সনে (দীঘির পশ্চিমপাড়ের অধিবাসী ) এরশাদ সরকারের মন্ত্রী মরহুম সিরাজুল হোসেন খান দীঘিটি সংস্কার করান। বর্তমান জরিপেও রেকর্ডভূক্ত মালিকানা বলে এর পাড়ে এখন পাঁকা দালান বাড়ী নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে!

ফলে প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্রে ভরপুর দীঘির শ্রী হারিয়ে দর্শণার্থীদের মর্মপীড়ার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

ইতিহাসবিদ ও সচেতন মহলের প্রশ্ন কেন দীঘিটি ন্যাশনাল হ্যারিটেজর হিসেবে তালিকাভূক্ত করা হলো না!

এই ঐতিহাসিক দীঘি খননের পেক্ষাপট ও রূপ কাহিনী নিয়ে বেতারে নাটক প্রচারিত হয়। কবি শাহজাহান বিশ্বাস জারিগান ও গীতিকাব্য রচনা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। 

এবং লেখক ও গবেষক আবু সালেহ আহমদ দীঘির রূপ কাহিনী নিয়ে একটি গবেষণা পত্র বাংলা একাডেমিতে জমা দিয়েছেন। 

এছাড়া লেখক ও নাট্যকার রুমা মোদক ‘রাণী কমলাবতীর দীঘি’ নামে রচিত নাটক হবিগঞ্জ জীবন সংকেত নাট্যগোষ্ঠী জেলাসহ বিভিন্ন জেলায় এ নাটক মঞ্চস্থ করা সহ বাংলাদেশ টেলিভিশনে নাটকটি মঞ্চায়ন করে সরাসরি সম্প্রচার করেছে। 

এতে বানিয়াচং ও সাগরদীঘি নতুন প্রজন্মের কাছেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। প্রায় সারা বছরই দীঘি ও ঐতিহাসিক গ্রাম পরিদর্শনে দেশী-বিদেশী পর্যটকরা এসে থাকেন।

বিবির দরগা জামে মসজিদ

বানিয়াচংয়ে আরও দুটি উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ হলো লক্ষ্মী বাঁওড় জলজ বন এবং বিথঙ্গল বৈষ্ণব আখড়া।

লক্ষ্মী বাঁওড় (জলজ বন): বানিয়াচং সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এই জলজ বনটি প্রায় ৩০০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এটি ‘হাওর কন্যা’ নামেও পরিচিত। এই বন ছয় মাস পানির নিচে ডুবে থাকে এবং শীতকালে এটি পরিযায়ী পাখির মেলায় পরিণত হয়। এখানে হিজল, করচ, বরুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও উভচর প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। শীত কালে ভ্রমণ পিপাসুদের আনাগোনা লক্ষণীয়। 

বিথঙ্গল আখড়া

বিথঙ্গল বৈষ্ণব আখড়া: বানিয়াচং উপজেলা সদর

থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই আখড়াটি বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি অন্যতম তীর্থস্থান। ষোড়শ শতাব্দীতে রামকৃষ্ণ গোস্বামী এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ১২০ জন বৈষ্ণবের জন্য ১২০টি কক্ষ রয়েছে। ৫০০ বছর আগে ত্রিপুরার রাজা উচ্চবানন্দ মানিক্য বাহাদুর ও তার স্ত্রী এই আখড়ায় প্রায়ই অবস্থান করতেন।

এখানে যেতে বর্ষাকালে সুবিধা বেশি, হেমন্তকালে সিএনজি অটোরিকশা অথবা মোটরসাইকেল যোগে যাতায়াতের সুবিধা ভাল।

পর্যটন বিকাশের সম্ভাবনা

বানিয়াচংয়ের এই অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে পর্যটন খাত থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব আয় করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন একটি সুপরিকল্পিত মাস্টার প্ল্যান।

ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ: রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, মসজিদ এবং মন্দিরগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ করে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা যেতে পারে। মোঘল আমলের কারুকাজ খচিত পুরানবাগ জামে মসজিদ, কালিকাপাড়া জামে মসজিদ ও বিবির দরগাহ জামে মসজিদ অন্যতম।

এগুলো বানিয়াচংয়ের ইতিহাসের অংশ।

সাগর দিঘি পুনরুদ্ধার: সাগর দিঘির দখল হওয়া অংশগুলো পুনরুদ্ধার করে এর পাড়ে হাঁটার পথ, বসার স্থান এবং রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করা যেতে পারে। এটিকে ‘ন্যাশনাল হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষণা করা হলে এর গুরুত্ব আরও বাড়বে। পাশাপাশি এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য বানিয়াচংয়ের ভেতরের রাস্তাগুলো উন্নত করা এবং হাওরের দিকে নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা দরকার।

রাজবাড়ি বানিয়াচং,

পর্যটন প্যাকেজ: লক্ষ্মী বাঁওড় ও বিথঙ্গল আখড়াসহ বানিয়াচংয়ের সব আকর্ষণীয় স্থানগুলোকে একত্রিত করে বিশেষ পর্যটন প্যাকেজ তৈরি করা যেতে পারে, যা পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় হবে।

বানিয়াচংয়ের পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসা উচিত। 

এর ফলে কেবল রাজস্ব আয়ই বাড়বে না, বরং স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হবে এবং বানিয়াচং বিশ্ব দরবারে নতুন করে পরিচিতি পাবে।

ট্যাগস :
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

‎সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় গরু-মহিষের চোরাচালান আটক: বিজিবি’র সাফল্য

বানিয়াচং পর্যটনের এক অপার সম্ভাবনাময় সুবর্ণভূমি।

সময় ০১:২৪:০২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
লক্ষীবাউর জলাবন, বর্ষায় দারুণ মনোমুগ্ধকর।

পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় সুবর্ণভূমি হলো হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রাম, যা এককালে পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। যদি এই গ্রামকে একটি পরিকল্পিত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তবে সরকার বছরে কোটি টাকার উপরে রাজস্ব আয় করতে পারবে। 

বানিয়াচংয়ের নৈসর্গিক রূপ, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং সমৃদ্ধ লোকগাথা এটিকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য এক অনন্য আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলতে পারে। 

ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও লোকসংস্কৃতি

এক সময়ের এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম ৩২.৪৩ বর্গ মাইল আয়তন ও দুই লক্ষ লোক সংখ্যার ভিত্তিতে পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে অনানুষ্ঠনিকভাবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। 

৪টি ইউনিয়নে বিভক্ত এ গ্রাম। মধ্যভাগে গড়ে উঠেছে উপজেলা শহর। চারপাশে গ্রামীণ সৌম্য পরিবেশ ও বর্ধিষ্ণু শহরের কর্মচাঞ্চলতায় অপূর্ব অনূভূতির সংমিশ্রণ ঘটায়। গড়ের খালের বেষ্টনী দিয়ে রেখেছে গ্রামটি কে।

পাখির চোখে কমলাবতীর দিঘি

কালের স্বাক্ষী রাজ-রাণী, শাহজাদা-শাহাজাদী ও জমিদার ও প্রজাদের কাহিনী নিয়ে আলাল-দুলাল (দেওয়ানা মদিনা) ছুরত জামাল ও অধূয়া সুন্দরী আমেনা সুন্দরী ও ফিরোজ খাঁ দেওয়ান, রাণী ভবাণী, রাজ কুমারী ও গায়েন, চৌধুরীদের লড়াই ও সিপাহী আফজাল খান ও জমিদার কন্যা আরজু বানুর উপখ্যান ও লোকগাঁথা পূর্ব বাংলায় লোক সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে দখল করে আছে। 

প্রাচীন নিদর্শন ও পুরাকীর্তি রাজবাড়ীর

ধ্বংসাবশেষ, ৫শ থেকে ২শ বছরের পূর্বের মুঘল স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত তিন গম্বুজ বিশিষ্ট ১১টি মসজিদসহ ১২০টি মসজিদ রয়েছে। 

৪শ বছরের প্রাচীন জয়কালী মন্দির ও শ্যাম বাউলের আখড়া এবং গ্রামের অদূরবর্তীতেই রয়েছে বিথঙ্গল বৈষ্ণব আখড়া ও সোয়াম ও রীড ফরেস্ট লক্ষী বাঁওড় (জলজবন) রয়েছে। 

প্রাকৃতিক শোভায় সুশোভিত ছয়টি দীঘি মুগ্ধ করে দেশী বিদেশী পর্যটকদের। 

বিশেষ করে বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম সাগর দীঘিকে ঘিরে রয়েছে পর্যটনের হাতছানি। 

ঘন বন-বনানী ও ঢাকা নগরীর আদলে আঁকাবাঁকা ও অসংখ্য সরু রাস্তা ধরে (দালান-অট্টালিকার স্থলে ) সারি সারি বৃক্ষরাজির সুশীতল ছায়া । 

দীঘি এবং পাঁচ শতাধিক পুকুর ও বিল-ঝিলের পাড়ে নান্দনিক ও শৈল্পিকভাবে গড়ে ওঠা সবুজে ঘেরা জন বসতির পাড়া ও মহল্লার অবস্থান বিমোহিত করে। 

পল্লী কবি জসিম উদ্দিন ঐতিহাসিক বানিয়াচংয়ে পরিদর্শনে এলে নয়নাভিরাম সাগর দীঘির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে এর পাড়ে বসেই ‘রাণী কমলাবতীর দীঘি’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। 

এ কবিতাটি তার সূচয়ণী কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। 

ঐতিহাসিকদের মতে, পঞ্চাশ খ্রীষ্টাব্দে হাওর দ্বীপে বানিয়াচং গ্রামের গোড়া পত্তন হয়। ধারনা করা হয় গ্রামের অভ্যন্তরে ও ওপাশ দিয়ে পুরাতন কুশিয়ারা ও এর শাখা সুটকী ও কেছুরিয়া নদী প্রবাহিত ছিল। 

ভূমিকম্পের বিবর্তনে নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তন ও মরা অংশ পলল ভূমিতে ভরাট হয়ে যাওয়ায়  প্রজাদের মধ্যে পানীয় জলের সংকট দেখা দেয়।

রাজন্যবর্গ ও পরবর্তীতে জমিদারগণ অসংখ্য পুকুর খননসহ সাগরদীঘি, দেওয়ানদীঘি, ঠাকুরাণীর দীঘি, মজলিশ খাঁর দীঘি, জামাল খাঁর দীঘি ও দেবাল দীঘি খনন করেন। এসব দীঘির অধিকাংশ দখল হয়ে ১৯৫৬ সালে এসএ রেকর্ডে চারপাড় বাসীর অনেকের মালিকানায় চলে যাওয়ায় আয়তনে ছোট হয়ে দীঘিগুলো রূপ বৈচিত্র হারিয়েছে এবং হারাচ্ছে। 

সাগর দিঘি

বিশেষ করে সাগরদীঘি ১২০ একরের মধ্যে ৬৬ একর সরকারের খাস খতিয়ানে রেকর্ড ভূক্ত হয়েছে। বিভিন্ন গ্রন্থে জানা যায়, দ্বাদশ শতাব্দীর কোন এক সময়ে রাজা পদ্মনাভ (মনাই রাজা) গ্রামের মধ্যভাগে ১২০ একর জায়গা জুড়ে এক বিশাল দীঘি খনন করেন। 

দীঘিতে পানি না ওঠায় স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে রাজা পদ্মনাভের স্ত্রী রাণী কমলাবতী আত্ম বিসর্জন দিলে দীঘিতে পানি ভরে ওঠে (এই নিয়ে লোকগাথা অনেক কল্পকাহিনী আছে)। তাই এ দীঘিকে ‘রাণী কমলাবতীর দীঘি’ সাগর দিঘি বলা হয়ে থাকে।

দীর্ঘদিনে অযত্নে অবহেলায় দীঘিটি ভরাট হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮৭ সনে (দীঘির পশ্চিমপাড়ের অধিবাসী ) এরশাদ সরকারের মন্ত্রী মরহুম সিরাজুল হোসেন খান দীঘিটি সংস্কার করান। বর্তমান জরিপেও রেকর্ডভূক্ত মালিকানা বলে এর পাড়ে এখন পাঁকা দালান বাড়ী নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে!

ফলে প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্রে ভরপুর দীঘির শ্রী হারিয়ে দর্শণার্থীদের মর্মপীড়ার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

ইতিহাসবিদ ও সচেতন মহলের প্রশ্ন কেন দীঘিটি ন্যাশনাল হ্যারিটেজর হিসেবে তালিকাভূক্ত করা হলো না!

এই ঐতিহাসিক দীঘি খননের পেক্ষাপট ও রূপ কাহিনী নিয়ে বেতারে নাটক প্রচারিত হয়। কবি শাহজাহান বিশ্বাস জারিগান ও গীতিকাব্য রচনা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। 

এবং লেখক ও গবেষক আবু সালেহ আহমদ দীঘির রূপ কাহিনী নিয়ে একটি গবেষণা পত্র বাংলা একাডেমিতে জমা দিয়েছেন। 

এছাড়া লেখক ও নাট্যকার রুমা মোদক ‘রাণী কমলাবতীর দীঘি’ নামে রচিত নাটক হবিগঞ্জ জীবন সংকেত নাট্যগোষ্ঠী জেলাসহ বিভিন্ন জেলায় এ নাটক মঞ্চস্থ করা সহ বাংলাদেশ টেলিভিশনে নাটকটি মঞ্চায়ন করে সরাসরি সম্প্রচার করেছে। 

এতে বানিয়াচং ও সাগরদীঘি নতুন প্রজন্মের কাছেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। প্রায় সারা বছরই দীঘি ও ঐতিহাসিক গ্রাম পরিদর্শনে দেশী-বিদেশী পর্যটকরা এসে থাকেন।

বিবির দরগা জামে মসজিদ

বানিয়াচংয়ে আরও দুটি উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ হলো লক্ষ্মী বাঁওড় জলজ বন এবং বিথঙ্গল বৈষ্ণব আখড়া।

লক্ষ্মী বাঁওড় (জলজ বন): বানিয়াচং সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এই জলজ বনটি প্রায় ৩০০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এটি ‘হাওর কন্যা’ নামেও পরিচিত। এই বন ছয় মাস পানির নিচে ডুবে থাকে এবং শীতকালে এটি পরিযায়ী পাখির মেলায় পরিণত হয়। এখানে হিজল, করচ, বরুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও উভচর প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। শীত কালে ভ্রমণ পিপাসুদের আনাগোনা লক্ষণীয়। 

বিথঙ্গল আখড়া

বিথঙ্গল বৈষ্ণব আখড়া: বানিয়াচং উপজেলা সদর

থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই আখড়াটি বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি অন্যতম তীর্থস্থান। ষোড়শ শতাব্দীতে রামকৃষ্ণ গোস্বামী এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ১২০ জন বৈষ্ণবের জন্য ১২০টি কক্ষ রয়েছে। ৫০০ বছর আগে ত্রিপুরার রাজা উচ্চবানন্দ মানিক্য বাহাদুর ও তার স্ত্রী এই আখড়ায় প্রায়ই অবস্থান করতেন।

এখানে যেতে বর্ষাকালে সুবিধা বেশি, হেমন্তকালে সিএনজি অটোরিকশা অথবা মোটরসাইকেল যোগে যাতায়াতের সুবিধা ভাল।

পর্যটন বিকাশের সম্ভাবনা

বানিয়াচংয়ের এই অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে পর্যটন খাত থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব আয় করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন একটি সুপরিকল্পিত মাস্টার প্ল্যান।

ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ: রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, মসজিদ এবং মন্দিরগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ করে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা যেতে পারে। মোঘল আমলের কারুকাজ খচিত পুরানবাগ জামে মসজিদ, কালিকাপাড়া জামে মসজিদ ও বিবির দরগাহ জামে মসজিদ অন্যতম।

এগুলো বানিয়াচংয়ের ইতিহাসের অংশ।

সাগর দিঘি পুনরুদ্ধার: সাগর দিঘির দখল হওয়া অংশগুলো পুনরুদ্ধার করে এর পাড়ে হাঁটার পথ, বসার স্থান এবং রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করা যেতে পারে। এটিকে ‘ন্যাশনাল হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষণা করা হলে এর গুরুত্ব আরও বাড়বে। পাশাপাশি এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য বানিয়াচংয়ের ভেতরের রাস্তাগুলো উন্নত করা এবং হাওরের দিকে নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা দরকার।

রাজবাড়ি বানিয়াচং,

পর্যটন প্যাকেজ: লক্ষ্মী বাঁওড় ও বিথঙ্গল আখড়াসহ বানিয়াচংয়ের সব আকর্ষণীয় স্থানগুলোকে একত্রিত করে বিশেষ পর্যটন প্যাকেজ তৈরি করা যেতে পারে, যা পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় হবে।

বানিয়াচংয়ের পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসা উচিত। 

এর ফলে কেবল রাজস্ব আয়ই বাড়বে না, বরং স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হবে এবং বানিয়াচং বিশ্ব দরবারে নতুন করে পরিচিতি পাবে।