
সিলেটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মান সৈন্যদলের সামরিক ব্যারাক ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী আসাম প্যাটানের স্থাপনার এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের শহিদ সামসুদ্দিন আহমদ ছাত্রাবাস সংস্কার করে রক্ষা ও আবু সিনা ছাত্রাবাস ভেঙে নির্মিত হাসপাতাল চালুর দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছে নাগরিক ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংগঠন।
বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সিলেটের জেলা প্রশাসনে এই স্মারকলিপি দেওয়া হয়। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম স্মারকলিপিটি গ্রহণ করেন। সিলেটের নাগরিক সংগঠন সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল করিম চৌধুরী কিমের নেতৃত্বে আইনজীবী অরূপ শ্যাম বাপ্পী, রেজাউল কিবরিয়া, রোমেনা বেগম রোজি, সোহাগ তাজুল আমিন ও আব্দুর রহমান হীরা স্মারকলিপি হস্তান্তর করা হয়।
সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলনসহ পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্টের স্মারকলিপিতে বলা হয়, সিলেট নগরীর কেন্দ্রস্থলের চৌহাট্টার সীমানাপ্রাচীর বেষ্টিত খোলা পরিসরে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের পুরাতন ক্যাম্পাস অবস্থিত।
মেডিকেলের এই পুরাতন ক্যাম্পাস ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বকালীন প্রতিষ্ঠিত হয়। জার্মান সৈন্যদের সামরিক ব্যারাক হিসেবে গড়ে ওঠা স্থাপনাটিই মুক্তিযুদ্ধে শহিদ চিকিৎসক ডা. সামসুদ্দিন আহমেদ ছাত্রাবাস নামে পরিচিত। স্থাপনার বয়স ৮৫ বছর।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সিলেটে মেডিকেল শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণের জন্য হাসপাতাল ও সংলগ্ন ছাত্রাবাস (হোস্টেল) নির্মাণ শুরু হয়।
ভবনগুলো নির্মাণে তৎকালীন ‘আসাম প্যাটার্ন আর্কিটেকচার’ অনুসরণ করা হয়। এর মধ্যে উঁচু ছাদ, লম্বা বারান্দা, ঢালু ছাদ, কাঠ ও ইটের সমন্বিত নির্মাণকৌশল বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।
১৯৩৬-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ভবনটি সিলেট সদর হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৪৮ সালে সিলেট মেডিকেল স্কুল স্থাপিত হলে এটি ছাত্রাবাস ও হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।
১৯৬২ সালে সিলেট মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এই ছাত্রাবাস কলেজ শিক্ষার্থীদের মূল হোস্টেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ছাত্রাবাসটি দুটো যুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে।
এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এটি মিলিটারি ব্যারাক সংস্কৃতির একমাত্র চিহ্ন। আর মুক্তিযুদ্ধে এখান থেকে সংগঠিত হওয়ার তথ্যাবলীও রয়েছে। আমাদের স্থাপত্য ঐতিহ্যের আসামবাড়ি কাঠামো সরকারি স্থাপনার মধ্যে টিকে থাকারও একটি নিদর্শন।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী পুরোনো ও জরাজীর্ণ হওয়ায় স্থাপনাগুলো অপসারণের প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবে বৃক্ষ কর্তনে নিলাম বিজ্ঞপ্তি স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে।
গাছ কাটার সংখ্যা ও বাস্তবতায় ফারাক রয়েছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ হিসেবে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের প্রশাসনিক দপ্তর লুকোচুরি লক্ষ্যণীয়।
সিলেটের নাগরিকসমাজ, পরিবেশবাদী ও ঐতিহ্য এবং পুরাকীর্তি সংরক্ষণসচেতন মানুষ মনে করেন, এই ঐতিহ্যবাহী ভবনসমূহ কেবল জরাজীর্ণ স্থাপনা নয় এটি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের দৃশ্যমান প্রতীক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এবং ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য নকশার এই ভবন সমূহ ধ্বংসের উদ্যোগে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ ধরনের পদক্ষেপ দেশে প্রচলিত আইনেরও পরিপন্থী বটে। ঐতিহাসিক এই স্থাপনা সমূহের ঐতিহ্য, নান্দনিকতা, ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও আইনগত মর্যাদা রক্ষার্থে এর ভেঙ্গে ফেলার প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধ করতে জরুরি প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রয়োজনে ভবন সমূহ মেরামত করা যেতে পারে কিংবা অতি জীর্ণ হলে একই স্থাপত্য নকশা ও রীতি মেনে তা পুননির্মাণ করা যেতে পারে।
আসাম কাঠামোর স্থাপনা সিলেটের আদি ঐতিহ্য উল্লেখ করে স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, ইতিপূর্বে সিলেট এমসি কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাস আগুনে ভস্মীভূত হলে সরকারি উদ্যোগে তা একই স্থাপত্য রীতিতে পুননির্মাণ করা হয়।
সিলেটের নাগরিক সমাজ কোনোভাবেই উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বিরোধী নন। কিন্তু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, যেকোনো উন্নয়নমূলক কার্যক্রম ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষা ও সংরক্ষনের মাধ্যমেই সম্পন্ন করতে হবে।
স্মারকলিপির দ্বিতীয় ভাগে বলা হয়, সিলেটের নাগরিক সমাজ অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সিলেট জেলা হাসপাতালের নির্মান কাজ ২০২৪ সালে সম্পন্ন হলেও এখনও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
নাগরিক সমাজের আপত্তি উপেক্ষা করে ঐতিহ্যবাহী আবু সিনা ছাত্রাবাস ভেঙে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে নগরের চৌহাট্টা এলাকায় এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের মতামত না নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করাসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে এই হাসপাতাল ভবনের দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছে না কেউ।
ফলে হাসপাতাল কমপ্লেক্স বুঝিয়ে দেওয়ার মতো কর্তৃপক্ষ পাচ্ছে না গণপূর্ত বিভাগ। জেলা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সিভিল সার্জন অফিসসহ কেউই এর দায়িত্ব নিতে রাজি নয়।হাসপাতালটির পরিকল্পনা করার সময় স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করায় এর দায়িত্ব নিতে এই অনীহা দেখা দিয়েছে।
অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হলেও এখনও কোনো চিকিৎসা সরঞ্জাম স্থাপন করা হয়নি। এমনকি প্রাঙ্গণ ঘেরার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতিও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মিত একটি হাসপাতাল দীর্ঘদিন অব্যবহৃত পড়ে থাকলেও এটি চালুর কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই।
হাসপাতাল চালুর বিষয়ে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও সমন্বয়হীনতা স্পষ্টত দৃশ্যমান।। এর ফলে একদিকে যেমন সরকারি সম্পদের বিপুল অপচয় হচ্ছে, তেমনি সিলেটের জনসাধারণ স্বাস্থ্যসেবা হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ নির্মাণকাজের শুরুতে সংশ্লিষ্টরা বলেছিলেন, এটি চালু হলে ওসমানী হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে। সিলেট অঞ্চলের রোগীরা এখান থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে সেবা নিতে পারবেন।
স্বারকলিপি হস্তান্তর করে সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা চাই, পরিবর্তিত অবস্থায় যেন আগের সরকারের কর্মকান্ডের পুনরাবৃত্তি না হয়। জেলা প্রশাসনের পক্ষে বিষয়টি দেখে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করার বিষয়টি জেলা প্রশাসক আমাদের জানিয়েছেন।’